সোমবার, ২১ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা আজ

দেশের সর্ববৃহৎ পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

জিন্নাতুন নূর

শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা আজ

বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নের গ্রামগুলো ছয়-সাত বছর আগেও ছিল অবহেলিত। কাঁচা সড়ক ও টিনের ঘরবাড়ি ছাড়া আশপাশে উঁচু দালানকোঠা তেমন চোখে পড়ত না। কিন্তু এখন সেই দৃশ্যপট একেবারে পাল্টে গেছে। দেশের সবচেয়ে বড় পায়রা কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ঘিরে এ অঞ্চলে শুরু হয়েছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। দেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বাধুনিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উদ্বোধন হতে যাচ্ছে আজ ২১ মার্চ। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুটি ইউনিটের উৎপাদনের সব নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। গত ১৮ মার্চ পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুই ইউনিটের মোট ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের মধ্যে ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এ কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থেকে আজ এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উদ্বোধন করবেন। একই দিন তিনি সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী শতভাগ বিদ্যুতায়নেরও ঘোষণা দেবেন।

প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নতুন সাজে সাজানো হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অভ্যন্তরে করা হবে সুধী সমাবেশ। এতে অতিথি থাকবেন প্রায় ৭০০ জন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সচিব, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরাও এতে উপস্থিত থাকবেন। করোনাকালের দীর্ঘ বিরতির পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও সশরীরে এ ধরনের বড় কোনো আয়োজনে যোগ দিচ্ছেন।

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় দেশের বিদ্যুতের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী ছিল ৪৭ শতাংশ। কিন্তু গত ১৩ বছরের মধ্যেই কিছু দুর্গম পার্বত্য এলাকা বাদে দেশের ৯৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ এলাকা এখন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, পার্বত্য যে এলাকাগুলো বাকি আছে সেখানেও দ্রুত সৌরবিদ্যুৎ চলে যাবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির একেকটি ইউনিটের উৎপাদন ক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট। এত বড় মেগাওয়াট ক্ষমতার সিঙ্গেল ইউনিট দেশের আর কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত নেই। এতে ব্যবহার করা হয়েছে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি। এ প্রযুক্তি প্রথমবারের মতো দেশের কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। পৃথিবীতে এ ধরনের উন্নত প্রযুক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ সাধারণত ১০ বছরের আগে শেষ হওয়ার নজির নেই। কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই এর নির্মাণকাজ শেষ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি (প্রাইভেট) লি. (বিসিপিসিএল) সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ নর্থওয়েস্ট পাওয়ার কোম্পানি ও চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) মধ্যে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি হয়। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালীতে কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্মাণ শুরুর পর ২০২০ সালের ১৫ মে প্রথম ইউনিটের ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে দিতে সক্ষম হয় বিসিপিসিএল কর্তৃপক্ষ। পরে একই বছরের ৮ ডিসেম্বর দ্বিতীয় ইউনিটের ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। তবে গোপালগঞ্জ সাবস্টেশনের ধারণ ক্ষমতা কম থাকায় এবং গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকার আমিনবাজার পর্যন্ত সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় ইউনিটের বিদ্যুৎ এখন পর্যন্ত গ্রিডে সরবরাহ করতে পারছে না বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। এর মধ্যে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ায় এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও সম্ভব হয়নি। ১ হাজার একর জমির ওপর নির্মিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৯ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। প্রতিদিন এ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজন হবে ১৩ হাজার মেট্রিক টন কয়লা। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের জ্বালানি হবে আমদানিকৃত কয়লা। প্রকল্প এলাকায় মোট ছয়টি কয়লার ডোম হবে, যেখানে দুই মাসের ব্যবহারের সমপরিমাণ কয়লা মজুদ রাখার ব্যবস্থা থাকবে। আমদানিকৃত কয়লা আনতে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ নাব্য বাড়ানোর কাজ করছে। বন্দরের এই কাজ শেষ হলে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টন কয়লাবাহী জাহাজ সরাসরি জেটিতে ভিড়তে পারবে। মহামারির জন্য এখন পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশ থেকে কয়লা আমদানি করা হচ্ছে না। তবে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গেও কয়লা আমদানির ব্যাপারে যোগাযোগ করা হবে।

বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) এ এম খোরশেদুল আলম বলেন, ‘আমাদের সব কাজ শেষ। কেন্দ্রটি উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছি। কেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিটের সঞ্চালন লাইনের কাজ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। এ ছাড়া খুলনায় বিদ্যুৎ নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা আরেকটি রুট বের করেছি। এ মাসের মধ্যেই ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের ৮০ শতাংশ বিদ্যুতের লোড আমরা নতুন রুট দিয়ে দিতে পারব।’ তিনি জানান, ১৮ মার্চ পর্যন্ত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের মধ্যে ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এ কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। আর ঢাকা পর্যন্ত সঞ্চালন লাইন নির্মাণ শেষ হলে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। নতুন যে লাইন বের করা হয়েছে তা দিয়ে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে।

কয়েক বছর আগেও কৃষিকাজ ছাড়া ধানখালী ও আশপাশের গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের জীবিকা নির্বাহের তেমন কোনো পথ ছিল না। কিন্তু এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণকাজের জন্য এ এলাকার মানুষের আয়-উপার্জন বেড়েছে। প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রবেশের আগেই বানানো হয়েছে চওড়া সড়ক। তার দুই পাশে এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জেটি-সংলগ্ন বাজারে গড়ে উঠেছে সারি সারি দোকান। নতুন টিনের চকচকে দোকানগুলোয় সাজানো আছে খাদ্যদ্রব্য, তরকারি, গ্যাস সিলিন্ডার, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিকস পণ্য, কাপড়সহ বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য। বিক্রি ভালো হওয়ায় স্থানীয় লোকজন ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন এসে এখানে দোকান দিয়েছেন। স্থানীয় ক্রেতা ছাড়াও প্রকল্পের হাজার হাজার চীনা শ্রমিক এসব পণ্যের ক্রেতা। চীনা ক্রেতাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠায় বিক্রেতাদের অনেকে কাজ চালানোর মতো চীনা ভাষাও রপ্ত করেছেন।

সর্বশেষ খবর