বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঝুঁকি বাড়াচ্ছে হৃদরোগ

♦ অত্যাধুনিক প্রস্তুতি ও দক্ষতা বাড়ছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ♦ তবু বিদেশগামী রোগীর ভিড় ♦ জরুরি নীতিমালায় আধুনিকায়নের উদ্যোগ ♦ বাড়ছে কম বয়সী হৃদরোগীর সংখ্যা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ঝুঁকি বাড়াচ্ছে হৃদরোগ

দেশে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ধীরে ধীরে কমলেও বাড়ছে অসংক্রামক ব্যাধি। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে হৃদরোগ। হৃদরোগের মরণকামড় ঠেকাতে দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে যোগ হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল। এর পরও রয়েছে সংকট, কমেনি বিদেশগামী রোগীর ভিড়।

এ পরিস্থিতিতে আগামীকাল পালিত হবে বিশ্ব হার্ট দিবস। এ বছর ‘প্রথমেই নিজেদের হার্টকে জানা’র বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে শুরু হচ্ছে বিশ্ব হার্ট দিবসের ক্যাম্পেইন। হার্ট দিবস উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান আয়োজন করেছে নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম। খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনে পরিবর্তন করে হৃদরোগ প্রতিরোধে জোর দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। এর পাশাপাশি নীতিমালা যুগোপযোগী করে হার্ট ট্রান্সপ্লান্টসহ আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ ও সক্ষমতা বাড়াতে জোর দিচ্ছেন চিকিৎসাসংশ্লিষ্টরা।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাশেদা সুলতানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হৃদরোগ চিকিৎসায় দেশ অনেকদূর এগিয়েছে। এখন দেশের হাসপাতালেই মিলছে বিশ্বমানের সেবা। আমরা দক্ষ জনবল তৈরিতে নজর দিয়েছি। পাশাপাশি উন্নত প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হচ্ছে। দেশেই দেশের মানুষের সব চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, দেশে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ধীরে ধীরে কমলেও বাড়ছে অসংক্রামক ব্যাধি। বিশ্বব্যাপী ৭৮ শতাংশ মানুষের অসুস্থতার কারণ অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগ। এর মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বা শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা ও শ্বসনতন্ত্রজনিত অন্যান্য রোগ। প্রতি বছর দেশে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া রোগীর মধ্যে অসংক্রামক রোগাক্রান্ত ৬৭ শতাংশ। সংখ্যায় তা পৌনে ৬ লাখ। তাদের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যকই হৃদরোগী। অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত মৃতের ৩০ শতাংশ হৃদরোগী, ১২ শতাংশ ক্যান্সার, ১০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি শ্বসনতন্ত্রের রোগ, ৩ শতাংশ ডায়াবেটিস এবং ১২ শতাংশ অন্যান্য অসংক্রামক রোগ। বাকিরা মারা যান সংক্রামক রোগ বা আহত হয়ে। তরুণদের মাঝে হৃদরোগ বাড়ায় তৈরি হয়েছে নতুন শঙ্কা।

যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের ‘ফোর ডিকেডস অব কার্ডিয়াক সার্জারি ইন বাংলাদেশ : আ নোবেল জার্নি দ্যাট স্ট্যাটেড উইথ দ্য হেল্প অব জাপান’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৯৮১ সালে কার্ডিয়াক সার্জারি শুরু হলেও বর্তমানে যে সুবিধা রয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। ১৭ কোটি মানুষের জন্য এ অপর্যাপ্ত সুবিধা জনগণের চিকিৎসা চাহিদা মেটাতে পারছে না। যদিও শুরুর পর তুলনামূলকভাবে কার্ডিয়াক সার্জারি ও চিকিৎসা কেন্দ্র বেড়েছে। ১৯৯৭ সালে দেশে কার্ডিয়াক সার্জারি হয় দু শ’র বেশি। ২০১৬ সালে এসে তা ১১ হাজার ছাড়িয়ে যায় এবং ২০১৯ সালে প্রায় ১৩ হাজারে দাঁড়ায়। ২০১৭ সালে দেশে হৃদরোগে অস্ত্রোপচারের সুবিধা ছিল ২৫টি চিকিৎসা কেন্দ্রে, যা ২০২২ সালে ৩২টিতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে চারটি সরকারি, একটি সেনাবাহিনীর ও একটি স্বায়ত্তশাসিত মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২৬টি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা সুবিধার ৯৫ শতাংশই রাজধানীকেন্দ্রিক। ঢাকা বিভাগের ২৪টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, চট্টগ্রাম বিভাগের চারটি হাসপাতাল, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও সিলেট বিভাগে একটি করে হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারির সুবিধা রয়েছে।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এই হাসাপাতাল দ্বিতীয় বৃহৎ হৃদরোগ সেবা কেন্দ্র। ১ হাজার ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালে প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ রোগী ভর্তি থাকে। হাসপাতালের বহির্বিভাগে ১ হাজার রোগী, জরুরি বিভাগে প্রতিদিন ৩০০ রোগী চিকিৎসা নেন। প্রতিদিন ৩-৪টি ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়। হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি বিষয়ে জোর দিয়ে চিকিৎসক তৈরিতে এমডি কোর্স চালু করা হয়েছে। শিশুদের হার্টের ছিদ্র রোগ চিকিৎসায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফান্ড দিয়েছেন। এ ছাড়া কাতার চ্যারিটি, কাতার রেডক্রিসেন্টসহ দেশের বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে আমরা এমওইউ করে এসব ডিভাইস সাহায্য হিসেবে পাচ্ছি। গত বছর ৮১টি শিশুকে বিনামূল্যে এ ডিভাইস দেওয়া হয়েছে। এ বছর ১০০ এর বেশি শিশুর হার্টের ছিদ্র চিকিৎসায় এ ডিভাইস স্থাপন শুরু হয়েছে। আমরা স্বপ্ন দেখি দেশেই হবে হার্ট প্রতিস্থাপনসহ বিশেষায়িত সব চিকিৎসা।’

জাপানের কারিগরি সহায়তায় ১৯৮১ সালে দেশে প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। জন্মগত সেকান্ডাম টাইপ আট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট (হৃৎপিণ্ডের ওপরের কক্ষে ছিদ্র) আক্রান্ত চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের এক কলেজ শিক্ষার্থী এ সার্জারির প্রথম সুবিধাভোগী। বর্তমানে বছরে অসংক্রামক রোগের কারণে যে-সংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছে দেশে, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ হৃদরোগী। অন্যদিকে প্রতি বছরই বাড়ছে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। এসব রোগীর মধ্যে বিশেষ করে অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোমে আক্রান্তের বেশি মৃত্যু ঘটে সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে না পারার কারণে।

দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো হৃদরোগ চিকিৎসায় জোর দিচ্ছে। রাজধানীর পাঁচ তারকা হাসপাতাল থেকে শুরু করে ঢাকার বাইরের হাসপাতালেও চলছে হৃদরোগের নানা জটিল সার্জারি। গত বছর রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে দেশে প্রথমবারের মতো মেকানিক্যাল হার্ট ইমপ্লান্ট বা কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের হৃদরোগ চিকিৎসায় যোগ হয়েছে নতুন পালক। এ ধরনের অ্যাডভান্সড চিকিৎসাসেবা নিয়মিত করাই এখন চ্যালেঞ্জ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত দেশে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি সুবিধার মধ্যে ২২টি হাসপাতালে ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। বছরে এসব হাসপাতালে প্রায় ১২ হাজার বাইপাস সার্জারি হয়। প্রায় ১৬ হাজার হয় এনজিওপ্লাস্টি। হার্টের ব্লকসহ গুরুতর সমস্যা নির্ণয়ের জন্য ৫০ হাজারের বেশি এনজিওগ্রাম করা হয়। বিভাগীয় পর্যায়ে হৃৎপিণ্ডের বিভিন্ন রোগ শনাক্তে কয়েকটি রোগ নির্ণয় পদ্ধতি থাকলেও তাতে যন্ত্রাংশ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের স্বল্পতা রয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর