বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দেশে কার্ডিওভাসকুলার রোগ ব্যবস্থাপনা

ডা. রেয়ান আনিস, সিনিয়র কনসালট্যান্ট, কার্ডিওলজি বিভাগ, ইউনাইটেড হসপিটাল

দেশে কার্ডিওভাসকুলার রোগ ব্যবস্থাপনা

বাংলাদেশে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (সিভিডি) একটি মারাত্মক রোগ এবং মৃত্যুর প্রধান একটি কারণ। সিভিডির ব্যাপকতা, বিশেষ করে করোনারি আর্টারি ডিজিজ (সিএডি) মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদযন্ত্রের সমস্যাও ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে জন্মগত হৃদরোগের (সিএইচডি) প্রকোপ এবং ব্যাপ্তি সম্পর্কে মানুষের খুব কমই ধারণা রয়েছে। জন্মগত হৃদরোগ নির্ণয় করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি থাকা প্রয়োজন। নয়তো এ রোগ নির্ণয় সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের কারণ এবং পরবর্তী বিস্তার বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়; যার মধ্যে রয়েছে জেনেটিক প্রবণতা, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, আর্সেনিক, ভিটামিন ডি’র ঘাটতি, বায়ুদূষণসহ অন্যান্য সমস্যা। দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে হৃদরোগের উচ্চঝুঁকির প্রধান কারণ হিসেবে ডিসলিপিডেমিয়াকে দায়ী করা হয়। চর্বিজাতীয় খাবার, অতিরিক্ত ভাজাপোড়া খাবার, রান্নার তেল পুনর্ব্যবহার, রান্নায় অতিরিক্ত তেলের ব্যবহার এবং অতিরিক্ত রান্না যা ভিটামিনগুলো ধ্বংস করে এসবই ডিসলিপিডেমিয়ার কারণ হতে পারে। বাংলাদেশে ধূমপান একটি অতি সাধারণ অভ্যাস। ওজন বৃদ্ধি, তামাকের ব্যবহার, প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ, অত্যধিক লবণ গ্রহণ, অলস জীবনযাপন এবং বিপাকীয় সিনড্রোম হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এসব সত্ত্বেও ভ্রƒণের অপুষ্টির কারণে স্থায়ীভাবে শারীরবৃত্তীয় ও বিপাক প্রক্রিয়া ব্যাহত করে, যা প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে করোনারি আর্টারি ডিজিজের শঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। অতীতে হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য সরকারি সেক্টরের চিকিৎসকরা তাঁদের সীমিত সম্পদ দিয়ে সীমিত সেবা প্রদান করতেন। ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি) এবং ফোনোকার্ডিওগ্রাফ সুবিধাসহ প্রথম করোনারি কেয়ার ইউনিট তৈরি করা হয়েছিল। তৎকালীন কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজেস ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠার পরে ১৯৭৮ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজেস বা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হিসেবে নামকরণ করা হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ৩ এপ্রিল, ১৯৮১ সালে এ দেশে প্রথম সমন্বিত কার্ডিওভাসকুলার কেয়ার শুরু হয়। ওষুধ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বিশেষ ডায়াগনস্টিক সেবা এবং চিকিৎসা কৌশলও চালু করা হয়েছিল। ১৯৮০ সালে প্রথম স্থায়ী পেসমেকার বসানো হয়েছিল। ১৯৭৭ সালে চালু হলেও বাংলাদেশে সফলভাবে অ্যানজিওপ্লাস্টি করতে ১০ বছরের বেশি লেগে যায়।

বর্তমানে অসংখ্য হাসপাতাল উন্নতমানের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে আসছে, যার মধ্যে কিছু কিছু হাসপাতাল স্পেশালিই হৃদরোগ চিকিৎসার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। হৃদরোগ চিকিৎসাসহ মাল্টি-স্পেশালিটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইউনাইটেড হসপিটাল লিমিটেড, এভারকেয়ার হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, ল্যাবএইড হাসপাতাল ইত্যাদি। ইউনাইটেড হসপিটালের কার্ডিয়াক সেন্টারে আছে দেশের সবচেয়ে উন্নত এবং ব্যাপক পরিসরের কার্ডিয়াক সুবিধা। এ হসপিটালে গত ১৫ বছরে লক্ষাধিক হৃদরোগীর চিকিৎসা ও সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে। ডা. জাহাঙ্গীর কবির এবং তাঁর দল ইউনাইটেড হসপিটালে প্রথম সফল মেকানিক্যাল হার্ট ইমপ্লান্টেশন (এলভিএডি) সম্পন্ন করেন। মিনিম্যালি ইনভেসিভ কার্ডিয়াক সার্জারি এমআইসিএস, ইসিএমও, টিএভিআই, এআইসিডি, সিআরটিডিসহ ইমপ্লান্টেশনের মতো প্রক্রিয়াগুলো সবই ইউনাইটেড হসপিটালে করা হয়। ইউনাইটেড হসপিটাল দ্রুত কার্ডিয়াক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করে, যার একটি উদাহরণ হচ্ছে জরুরি বিভাগে প্রবেশ থেকে ক্যাথল্যাবে স্টেন্ট পরানো পর্যন্ত এই দক্ষ কার্ডিওলজি টিমের সময় লাগে মাত্র ৯০ মিনিট। উল্লেখ্য, ইউনাইটেড হসপিটাল আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ; যা সম্প্রতি জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনাল (জেসিআই)-এর স্বীকৃতি পেয়েছে। এ হাসপাতালে প্রতিটি সার্জারির আগে কঠোরভাবে আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া ‘টাইমআউট’ মেনে চলা হয়। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোগীর সঠিক অপারেশনের স্থান, প্রক্রিয়াসহ অপারেশন-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় আরেকবার নিশ্চিত করা হয়; যা সার্জারির যে কোনো ভুলের মাত্রা প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসে। ইউনাইটেড হসপিটাল তাদের প্রি-অপারেটিভ ও পোস্ট-অপারেটিভ বিভাগেও সেবার মানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সমানভাবে নিবেদিত। কার্ডিয়াক সার্জারির ক্ষেত্রে অ্যানেসথেসিয়ার ভূমিকা ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। সার্জারির আগে ও সার্জারি চলাকালে সাধারণত অ্যানেসথেসিয়া প্ল্যান অপরিবর্তিত থাকে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইউনাইটেড কার্ডিয়াক সেন্টারে অ্যানেসথেসিয়া-সম্পর্কিত মৃত্যুহারও শূন্য।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে ‘হৃদরোগ প্রতিরোধ’ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। জাতীয় প্রচারমাধ্যমে এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা পাঠ্যক্রমে হৃদরোগ বিষয়ে জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। একটি কর্মক্ষম জীবনপদ্ধতি মেনে চলা, সেই সঙ্গে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডিসলিপিডেমিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।

আমাদের জীবনে স্বাস্থ্যকর আচরণগুলোকে উৎসাহিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেমন হার্টের জন্য উপকারী ডায়েট খাওয়া, ধূমপান ত্যাগ করা, পরিমিত পরিমাণে লবণ খাওয়া এবং শারীরিক অনুশীলন করা। প্রক্রিয়াজাত খাবারে লবণ, চিনি, ট্রান্স ফ্যাট এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হৃদরোগ প্রতিরোধে বাংলাদেশকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

সর্বশেষ খবর