দেশে ইসলামিক ব্যাংক ব্যবস্থার কল্যাণকর বৈশিষ্ট্যের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হলো সামাজিক দায়বদ্ধতার উদারনৈতিক বহিঃপ্রকাশ। ইসলামিক ব্যাংকিং পণ্যগুলো সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক মঙ্গলের নেপথ্যে নিত্যক্রিয়াশীল। কল্যাণকর সেবাকার্যক্রমও তেমনি সামাজিক দায় পালনের এক বড় ধরনের দৃষ্টান্ত। শিক্ষার বিকাশ, প্রযুক্তি শিক্ষার ব্যাপকতা এবং আত্মকর্মসংস্থানমুখী দক্ষতা অর্জনে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ভূমিকা ও অবদান অবিস্মরণীয়। ইসলামী ব্যাংকগুলো জাতীয় উন্নয়ন প্রবাহে গতি বৃদ্ধির বিরল ভূমিকায় আপন স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে, এ দাবি মোটেও আবেগপ্রসূত নয়; সূচক-ভিত্তিক অবদানেরই বাস্তব প্রকাশ।
শিল্পায়নের দিকে তাকালে দেখা যায়, শুরু থেকেই উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে ইসলামী ব্যাংকগুলো। উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও তহবিল জোগানের মাধ্যমে সব ধরনের শিল্প-কারখানায় অবদান রাখছে ইসলামী ব্যাংকগুলো। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে ইসলামী ব্যাংকগুলোর। হালকা ও ভারী সব ধরনের শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানিতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছে এ ব্যাংকগুলো। শিল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে ৮৫ লাখ মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। শুধু হালকা ও ভারী শিল্পেই নয়, ইসলামী ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ এসএমই বিনিয়োগকারী ব্যাংক। দারিদ্র্য দূরীকরণ ও নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে প্রান্তিক পরিবারের মাঝে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রদান করেছে এ ব্যাংকগুলো। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ কর প্রদানকারী ব্যাংক। এভাবেই আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর সম্মিলিত শক্তিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা। মাত্র চার দশকের মধ্যেই ইসলামিক ব্যাংকিং বিভিন্ন খাতে, বিভিন্ন সূচকে এবং ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন ধারণাগত ভিত্তিতে এর মূলধন শেয়ার বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। যা জনসাধারণের ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি গভীর অঙ্গীকার ও অগ্রাধিকারেরই পরিচয় বহন করে। তাছাড়া ইসলামী ব্যাংকগুলো বৈধপথে ও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ, দারিদ্র্যবিমোচন ও আত্ম-কর্মসংস্থান, পল্লী ও কৃষি বিনিয়োগেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কিত বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকটি সার্কুলারই প্রমাণ করে যে, ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের দিকে সর্বসাধারণের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা ঝুঁকছে। ফলশ্রুতিতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বেশ কয়েকটি প্রচলিত ধারার ব্যাংক ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় রূপান্তরিত হওয়ার জন্য আবেদন করেছে। ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের প্রতি এদেশের সব ধরনের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন, আগ্রহ আছে বলেই ক্রমান্বয়ে তারা এর প্রতি ঈর্ষণীয়হারে ঝুঁকছেন। এরকম অবস্থায় ইসলামিক ব্যাংকিংকে গণমানুষের আরও কাছে নিয়ে যেতে প্রচলিত ধারার শাখাগুলোতে ‘ইসলামিক ব্যাংকিং অনলাইন সেবা’ নামে একটি হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা যেতে পারে। যেখানে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে দক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে হবে।ইসলামী ব্যাংকগুলো শুধু আর্থিক সেবা প্রদান করে না, বরং তারা সমাজের বিভিন্ন খাতে, বিশেষ করে শিক্ষা প্রযুক্তি ও আত্মকর্মসংস্থানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। যেমন- আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের উন্নয়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য স্বল্প মুনাফায় বিনিয়োগ প্রদান, যা শিক্ষার্থীদের জন্য উন্নত প্রযুক্তির সুবিধা নিশ্চিত করে। ইসলামী ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বিভিন্ন শিক্ষাবৃত্তি ও অনুদান দেওয়া হয়, এ উদ্যোগ শিক্ষার প্রসার ঘটাতে সহায়তা করে। আত্মকর্মসংস্থানের উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংকগুলো তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ বিনিয়োগ ও সহায়তা প্রদান করে। তারা ব্যবসার জন্য কার্যকরী পরিকল্পনা তৈরিতে সহায়তা করে এবং উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণও প্রদান করে, যা তাদের আত্মকর্মসংস্থানে সহায়তা করে। এমনকি ইসলামী ব্যাংকগুলোর মাইক্রোফাইন্যান্স প্রকল্পগুলো সাধারণত ছোট ব্যবসার উদ্যোক্তাদের জন্য উদ্দীপক।
ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হলো- সেবার প্রতিটি পর্যায়ে সততা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা; ব্যাংকিং সেবায় টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টাকে অভিনন্দিত করা এবং এসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে কার্যকর অবদান রাখা। আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে সঠিকভাবে বিনিয়োগ করা; দক্ষ গ্রাহক সেবা প্রদান করা; করপোরেট ও ব্যবসায়িক নীতি অনুসরণ করা; গ্রাহকের জমাকৃত অর্থের বিশ্বাসযোগ্য রক্ষণাবেক্ষণকারী হওয়া; ব্যাংকের বিভিন্ন সেবাকে সর্বোত্তম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া; পেশাদারি মনোভাব প্রদর্শন করা; শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তি সৃষ্টি করা; দাতব্য ও মানবিক কর্মকান্ড বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজের প্রতি প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা পূরণ করা। ইসলামী শরিআহ মোতাবেক সব ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা। আর্থিক কর্মকান্ড সম্পূর্ণভাবে সুদমুক্ত করা। ব্যাংকিং কার্যক্রম জনকল্যাণের লক্ষ্যে পরিচালনা করা। এ ছাড়াও স্বল্প আয়ের লোকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা; অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা; ইসলামী অর্থব্যবস্থার লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করা; অর্থের মূল্যমান স্থিতিশীল রাখা এবং মুদ্রাস্ফীতির কুফল থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত রাখা।
ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে বিনিয়োগের অন্যতম মাধ্যম হলো মুরাবাহা। ইসলামিক ব্যাংকিং কার্যক্রমে মুরাবাহার ক্ষেত্রে সাধারণত তিনটি পক্ষ থাকতে হয়, যেমন- (১) ব্যাংক (অর্থায়নকারী), (২) বিক্রেতা (যার কাছ থেকে ব্যাংক মাল ক্রয় করে) ও (৩) ক্রেতা বা গ্রাহক (যার কাছে ব্যাংক মাল বিক্রয় করে)। পণ্যের কেনা দাম ও লাভের অংক ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়েরই জানা থাকা মুরাবাহা পদ্ধতির একটি শর্ত। বিনিয়োগ করা পণ্যের মালিকানা প্রথম পর্যায়ে এক মুহূর্তের জন্য হলেও ব্যাংকের দখলে আসতে হবে। অতঃপর গ্রাহকের কাছে ন্যস্ত হবে। তা দুইভাবে হতে পারে। যেমন (ক) প্রত্যক্ষ দখল ও (খ) পরোক্ষ দখল। চুক্তি অনুযায়ী গ্রাহক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্যের সরবরাহ নিতে ও দাম পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবেন। বিক্রয় চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর শর্তের কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। মালামালের দখল গ্রাহককে বুঝিয়ে দিতে হবে। তা দুইভাবে হতে পারে। যেমন- (ক) পণ্য ওজন বা পরিমাপ করে কিংবা বিক্রেতা থেকে ক্রেতার অনুকূলে দখল হস্তান্তরের মাধ্যমে বস্তুগতভাবে বুঝিয়ে দেওয়া ও নেওয়া (খ) ক্রেতা যাতে পণ্য ব্যবহার করতে পারে সেজন্য তা বিক্রেতার দখলমুক্ত/অধিকারমুক্ত/নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে দেওয়া।
বাংলাদেশে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক অন্যতম। তৃতীয় প্রজন্মের ব্যাংক হয়েও এক্সিম ব্যাংক সব ধরনের আর্থিক সূচকে শক্ত অবস্থান নিয়ে প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে এবং দেশে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার উন্নয়নে সার্বিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।