সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা
সা ক্ষাৎ কা র

ব্যাংক খাতে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে

মোহাম্মদ আবু জাফর, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, দি প্রিমিয়ার ব্যাংক পিএলসি

ব্যাংক খাতে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে

চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে আসছে ইসলামিক ব্যাংকিং। অর্থনীতির বিভিন্ন শাখায় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার মার্কেট শেয়ার এর দৃঢ় অবস্থানের সাক্ষ্য দেয়। ব্যাংক আমানতের প্রায় ২৬%, বিনিয়োগের ২৮%, আমদানির ২৬%, রপ্তানির ২৪%, রেমিট্যান্সের ৩৯%, শিল্পায়নের বিনিয়োগে ২৭%, কৃষি খাতে বিনিয়োগের ১৭% এবং ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প বিনিয়োগের ৩৫% রয়েছে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের দখলে। এ ছাড়া সিএসআরের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে ইসলামিক ব্যাংক খাত। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, দারিদ্র্যবিমোচন ও পরিবেশ সংরক্ষণসহ বিভিন্ন খাতে অংশগ্রহণ করে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপী ইসলামিক ফাইন্যান্স জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। দেশেও শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা বেশ জনপ্রিয়। বর্তমানে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের পাশাপাশি ২৭টি প্রচলিত ধারার ব্যাংক উইন্ডো/ স্বতন্ত্র ব্রাঞ্চের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে। ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের মোট আমানত প্রায় ৪,৪০৪.২৭ বিলিয়ন টাকা এবং বিনিয়োগ প্রায় ৫,১৩৭.৩৪ বিলিয়ন টাকা। ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য হওয়ায় ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে ঝোঁকার একটি বড় কারণ। ইসলামিক ব্যাংকিং এবং প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে চুক্তিগত পার্থক্য রয়েছে। প্রচলিত ধারার ব্যাংক আমানত এবং ঋণ- এই দুই ক্ষেত্রে সুদ আরোপ করে থাকে। যেখানে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মূল ভিত্তি হলো শরিয়াহ পরিপালন। শরিয়াহ নীতি অনুযায়ী আর্থিক লেনদেনের সর্বক্ষেত্রে সুদ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আমানত গ্রহণে পূর্ব নির্ধারিত রেট উল্লেখ না করে প্রফিট শেয়ারিং রেশিও ভিত্তিতে চুক্তি সম্পাদন করে থাকে। বছরান্তে প্রকৃত মুনাফা অর্জনের ওপর ভিত্তি করে গ্রাহককে চূড়ান্ত মুনাফা দেওয়া হয়। আবার গ্রাহকের কাছ থেকে সংগৃহীত আমানত বিভিন্ন ব্যবসায়িক চুক্তি যেমন মুরাবাহা (ক্রয়-বিক্রয়), মুশারাকা (অংশীদারি ভিত্তিতে) অথবা হায়ার পারচেজ ইত্যাদি শরিয়াহ নির্দেশিত চুক্তির আওতায় বিনিয়োগ করা হয়। এর মাধ্যমে ব্যাংক এবং গ্রাহকের মাঝে ঝুঁকি ভাগাভাগি হয়ে থাকে, যা একটি ন্যায্যতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করে। চুক্তির বেলায় যে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা পরিহারও ইসলামী শরিয়াহর একটি মৌলিক বিষয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো সামাজিক দায়বদ্ধতা। বিনিয়োগগুলো এমন খাতে হবে যেখানে সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত হয়। ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে আমানত সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় মুদারাবা একটি জনপ্রিয় ইসলামী নীতি ও পদ্ধতি। এ প্রক্রিয়ায় ব্যাংক ও আমানতকারীর মধ্যে একটি চুক্তি হয়। যার মধ্যে আমানতকারী অর্থ জমা করেন তিনি মালের মালিক বা সাহেবুল মাল এবং যিনি ব্যবসা পরিচালনা করেন (ব্যাংক) তিনি মুদারিব বা ব্যবসা পরিচালনাকারী। মুদারাবা চুক্তিতে ব্যবসায় লাভ হলে দুই পক্ষ চুক্তি অনুসারে লাভ পেয়ে থাকে। আর কোনো লোকসান হলে তা সাহেবুল মাল বহন করে। এক্ষেত্রে মুদারিবের লস হলো তার সময়, শ্রম, মেধা ইত্যাদি। ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে বিনিয়োগ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে মুরাবাহা অতি প্রচলিত ও সর্বজনগ্রাহ্য একটি বিনিয়োগ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ব্যাংক বিনিয়োগ গ্রাহকের চাহিদা মোতাবেক (দেশের প্রচলিত আইন ও শরিয়াহ অনুমোদিত প্রোডাক্ট) পণ্য ক্রয় করে তার সঙ্গে মুনাফা যোগ করে বিক্রয় করে থাকে। AAOIFI এর সংজ্ঞা মতে, “মুরাবাহা হলো নির্ধারিত ও সম্মত লাভের ভিত্তিতে পন্য বিক্রি।” ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে তহবিল ব্যবহার ও অর্থ উপার্জনের জন্য যেসব শরিয়াহসম্মত পদ্ধতি রয়েছে তার মধ্যে মুশারাকা পদ্ধতি হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। এক বা একাধিক ব্যক্তি ও সংস্থা মুশারাকা পদ্ধতিতে লাভ-লোকসান বণ্টনের শর্তে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে বা সম্পদ কিনতে পারে। এক্ষেত্রে সম্পদের পুঁজি সমান বা অসমান হতে পারে। ব্যবসায় লাভ হলে চুক্তি অনুসারে লাভ বণ্টন হয় আর লোকসান হলে পুঁজি অনুপাতে লোকসান বহন করতে হয়। জুন ২০২৪ ভিত্তিক দেশের সামগ্রিক আমানতের দিকে তাকালে দেখা যায় ব্যাংক খাতে মোট আমানত ১৭,৪২,৭৯৫ কোটি টাকা; যার মধ্যে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত ৪,৪০,৪২৭ কোটি টাকা। বর্তমানে দেশে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের পাশাপাশি ২৭টি প্রচলিত ধারার ব্যাংক উইন্ডো/স্বতন্ত্র ব্রাঞ্চের মাধ্যমে ইসলামিক ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ইসলামিক ব্যাংকিং শাখা ও উইন্ডোগুলোর আমানতের পরিমাণ ৪২,৩৫৩ কোটি টাকা যা মোট ইসলামিক ব্যাংকগুলোর আমানতের ৯.৬%। এই সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক অনলাইনে ইসলামিক ব্যাংকিং সেবা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে। এ নির্দেশনার ফলে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর যাদের ইসলামী শাখা ও উইন্ডো আছে, তারা আমানত সংগ্রহ ও আমানতকারীদের কাছে আরও কম সময়ে ও দ্রুত সেবা পৌঁছে দিতে পারছে। ফলে আমানতকারীদের সময় অপচয় হ্রাস পাচ্ছে এবং আমানতকারী স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামিক ব্যাংকিং সেবা প্রদানের মাধ্যমে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও এই ব্যাংকিং সেবা নিতে পারছে। ইতোমধ্যে দি প্রিমিয়ার ব্যাংক পিএলসি দুটি স্বতন্ত্র ইসলামিক ব্যাংকিং শাখা ও ইসলামিক ব্যাংকিং উইন্ডোর মাধ্যমে ইসলামিক ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। স্বাধীনতা-উত্তর দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ছিল কৃষি খাত। তবে সময়ের পরিবর্তনে এবং চাহিদার প্রেক্ষিতে সেবা ও শিল্প খাত বর্তমানে উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। যদিও কৃষি খাতে শ্রমের বড় একটি অংশ এখনো নিয়োজিত রয়েছে।  ফলে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, বেকারত্ব দূরীকরণ ও দারিদ্র্যবিমোচনে তথা সামগ্রিক উন্নয়নে ইসলামিক ব্যাংকগুলো সদৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারে।

অংশীদারিত্বমূলক বিনিয়োগ বৃদ্ধি : সুদের প্রকৃত বিকল্প হচ্ছে মুদারাবা ও মুশারাকার ভিত্তিতে লাভ-লোকসানে অংশীদারিত্বমূলক ব্যবসা, যদিও ক্রয়-বিক্রয় বা ইজারা পদ্ধতিও সম্পূর্ণ শরিয়াহসম্মত বিনিয়োগ পদ্ধতি। তবে এসব পদ্ধতি প্রচলিত ধারার ব্যাংকিং প্রোডাক্টের সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যায় বলে সাধারণ লোকদের মধ্যে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের সৌন্দর্য প্রকাশিত হয় না। বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো যেহেতু এখন একটি মজবুত ভিত্তির ওপর  দাঁড়িয়েছে তাই ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের প্রকৃত সৌন্দর্য লাভ-লোকসানে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অর্থায়নের পরিমাণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

জনসচেতনতা সৃষ্টি : বিপুল জনগোষ্ঠীকে ইসলামিক ব্যাংক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক প্রোগ্রাম হাতে নিতে হবে। যেমন- সুদের জাগতিক ও ধর্মীয় কুফল, ইসলামিক ব্যাংকিং ও প্রচলিত ধারার ব্যাংকিয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য, জনকল্যাণে গৃহীত ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মসূচি, স্কিম, বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের জন্য উপযোগী ইসলামিক ব্যাংকিং প্রোডাক্টকে পরিচিত করে তোলার জন্য সভা, সেমিনার, গেট টুগেদার, সিম্পোজিয়ামের আয়োজন। এ সংক্রান্ত পুস্তিকা, হ্যান্ডবিল, লিফলেট, ফ্লায়ার ইত্যাদি প্রকাশনা জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে বিতরণ করা যেতে পারে।

যুগোপযোগী ইসলামী ব্যাংকিং প্রোডাক্ট উদ্ভাবন : পরিবর্তিত ব্যবসায়িক চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী ইসলামিক ব্যাংকিং প্রোডাক্ট। বিশেষ করে গ্রাহকের নগদ টাকার চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ ও সহজে অনুশীলনযোগ্য বিনিয়োগ প্রোডাক্ট প্রবর্তন খুবই জরুরি। এ জন্য প্রয়োজন নিবিড় গবেষণা। তাই ইসলামী ব্যাংকগুলো এককভাবে বা যৌথভাবে গবেষণার উদ্যোগ নিতে পারে। নতুন এবং যুগোপযোগী ইসলামিক ব্যাংকিং প্রোডাক্ট উদ্ভাবনের মাধ্যমে জনগণকে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ে আগ্রহশীল করা যেতে পারে।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে নৈতিকতার ভিত্তিতে ঢেলে সাজানো ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের কর্মমুখী ও সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রেখে চলেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষায়, “দারিদ্র্যমুক্তির উপাদান প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে সুস্পষ্টভাবে রয়েছে।” ব্যক্তির এই সুপ্ত সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলতে এবং তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনসংখ্যাকে সম্পদে রূপান্তরে  বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন- পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি, দুস্থ ও স্বল্প আয় নারীদের কর্মসংস্থান ইত্যাদি।

সর্বশেষ খবর