বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ নৌবাহিনী

লে. কমান্ডার মো. জালালউদ্দীন বীরউত্তম

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ নৌবাহিনী

চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে পাকিস্তানিদের এই জাহাজ ধ্বংস করেছিল নৌ-কমান্ডোরা

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আমি পাকিস্তান নেভির চট্টগ্রাম নৌঘাঁটিতে কর্মরত ছিলাম। ২৬ মার্চ নিরস্ত্র অবস্থায় ব্যারাকে বসে পাকিস্তান বাহিনীর নির্মমতার বহু ঘটনা দেখতে পাই। মন বিদ্রোহী হয়ে উঠলেও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম। এ সময় চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নানের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে পাই। এ ঘোষণায় মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান নেভির ঘাঁটি ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিই। ২৬ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রামের হালি শহর সেক্টরে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করি। কিন্তু ৩১ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্র ও জনবলের কাছে আমাদের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে যায়। চট্টগ্রামে থেকে যুদ্ধ করা সে সময় আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাগুরার মোহাম্মদপুর থানায় চলে আসি। কখনো হেঁটে কখনো রিকশায়, কখনো বাস কিংবা লঞ্চে ৫ এপ্রিল গ্রামের বাড়িতে পৌঁছি।

মাগুরায় পৌঁছে নতুন উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার চেষ্টা চালাই। এরই মধ্যে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন হয়। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে ১৭ জন ছাত্র মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ২৬ এপ্রিল ভারতে যাত্রা করি। তিন দিন হেঁটে কলকাতার রানাঘাট ক্যাম্পে পৌঁছি। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন আসাদুজ্জামান এমপি। তার কাছে সহযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধাদের রেখে ২৮ এপ্রিল কলকাতা যাই। ৩০ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী প্রধান জেনারেল ওসমানীর নির্দেশে চব্বিশ পরগনায় টাকি ক্যাম্পে যাই। সেখান থেকে ৯০ জন ছাত্র নৌ-কমান্ডোকে সঙ্গে নিয়ে ১২ মে পলাশী ক্যাম্পে যোগদান করি। সেখানে দুই মাস ২০ দিন নৌ-কমান্ডো হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।

পলাশী ক্যাম্প থেকে নৌপ্রশিক্ষণ শেষে আগস্টে নৌ-কমান্ডোদের সঙ্গে নিয়ে অপারেশন জ্যাকপটে অংশ নিই। ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিরণ পয়েন্ট সুন্দরবন ও মংলা বন্দরে একের পর এক অভিযান চালাই। ১৫ সেপ্টেম্বর দেশি নৌকা করে ১২ জন নৌ-কমান্ডোসহ ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করি। ১৭ সেপ্টেম্বর চুনকুড়ি নদীর বেড়িবাঁধে অবস্থান নিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নবাবদীর বাহিনীর সঙ্গে মিলে পাক গানবোট রাজশাহীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হই এবং নৌ-কমান্ডো ও মুক্তিবাহিনী হামলার মুখে পাকিস্তানি গানবোট পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। এরপর ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতে ফিরে যাই এবং নৌ-উপদেষ্টাকে দুটি গানবোট দেওয়ার জন্য তদবির করতে থাকি। নৌ-উপদেষ্টা ও আমার ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টায় মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোদের জন্য গানবোট দিতে ভারত সরকার রাজি হয়। এরপর ভারতের আগরতলা থেকে আগত ৫০ জন বাঙালি নাবিককে নিয়ে আমি কলকাতা গার্ডেনরিচ ডকইয়ার্ডে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ পদ্মা এবং পলাশ তৈরিতে মনোনিবেশ করি। প্রত্যেক গানবোটে দুটি করে বিমান বিধ্বংসী কামান স্থাপন করি। বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর যুদ্ধজাহাজ পদ্মা ও পলাশ তৈরি হওয়ার পর আইএনএস হুগলির জেটিতে স্থানান্তর করে গোলাবারুদ, রসদ ও প্রয়োজনীয় অস্ত্রসজ্জা করা হয় এবং ১২ অক্টোবর ১৯৭১ ওই জেটিতেই কলকাতার মেয়র যুদ্ধজাহাজ দুটি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর গানবোট পদ্মা ও পলাশকে দামোদার নদীর পূর্বপাড়ে হলদিয়া নৌজেটিতে নেওয়া হয়। সেখানে গানবোট দুটিতে ৪টি করে ৮টি মার্ক ১১ গ্রাউন্ড মাইন সজ্জিত করা হয়। প্রতিটি মাইন ছিল প্রচণ্ড আঘাত হানার ক্ষমতাসম্পন্ন।

১০ নভেম্বর ১৯৭১ যুদ্ধজাহাজ পদ্মা এবং পলাশ হলদিয়া নৌজেটি ত্যাগ করে মংলা বন্দরে প্রবেশদ্বারে মাইনগুলো ফেলে রাখার জন্য যাত্রা শুরু করি এবং রাতে মাইনগুলো ফেলে হলদিয়া নৌঘাঁটিতে ফেরার পথে একটি পাকিস্তানি মালবাহী জাহাজ গোলাবারুদ, খাদ্যসহ ধরে নিয়ে কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করি। ১১ নভেম্বর মংলা বন্দরে প্রবেশকালে ৪টি মালবাহী জাহাজ মাইনের আঘাতে ডুবে যায়। এরপর পাক গানবোট পিএনএস তোফায়েল ওই স্থানে গেলে মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায়, জাহাজে কর্মরত চার নৌকর্মকর্তা ও ৩৬ নৌসেনা মৃত্যুবরণ করে। মুক্তিযুদ্ধে নৌকমান্ডোদের পেতে রাখা মাইনে চট্টগ্রাম ও মংলা সামুদ্রিক বন্দরে জাহাজ চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তানিরা নৌপথে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর ভারতীয় গানবোট আইএনএস পানভেল এবং মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোদের পরিচালনাধীন পদ্মা ও পলাশ এক দুঃসাহসিক অভিযানে খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে পৌঁছে। এ সময় দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেম সাইডের ঘটনা ঘটে। ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তানি গানবোট ভেবে হামলা শুরু করলে গানবোট পদ্মা ও পলাশ ধ্বংস হয়ে যায়। বিমান হামলায় বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীনসহ আট নৌসেনা শাহাদতবরণ করেন। আইএনএস পানভেলের অবশ্য কোনো ক্ষতি হয়নি। আমি ওই অভিযানে গানবোট পদ্মায় ছিলাম এবং পায়ে গুলি লাগা অবস্থায় সাঁতরিয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হই। মুক্তিযুদ্ধের সময় নৌবাহিনী গঠনে ভূমিকা রাখা, সফলভাবে অপারেশন জ্যাকপটে অংশগ্রহণ, সমুদ্রপথে মাইন পেতে রেখে জাহাজ ডুবিয়ে পাকিস্তানি নৌবাহিনী ও বাণিজ্যিক জাহাজের যাতায়াতের পথ রুদ্ধ করা এবং দুঃসাহসিক খুলনা অভিযানের প্রেক্ষাপটে সরকার আমাকে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বীরত্ব পদক বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এটিই ছিল সর্বোচ্চ পদক।

স্মর্তব্য, ১৯৫৬ সালের ২২ জুন আমি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দিই। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ খাইবারে কর্মরত থাকা অবস্থায় কচ্ছের রান যুদ্ধে অংশ নিই। ১৯৬৪ সালে যুদ্ধজাহাজ বাবরে কর্মরত থাকা অবস্থায় ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে কমিশন লাভ করি এবং ১৯৯০ সালে লে. কমান্ডার হিসেবে নৌবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করি।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা।

সর্বশেষ খবর