শিরোনাম
২০ নভেম্বর, ২০১৫ ১৩:০৫
লেখকের অন্য চোখ

রাজনৈতিক নেতারা দুই রকমের

সমরেশ মজুমদার

রাজনৈতিক নেতারা দুই রকমের

আচ্ছা, পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতার সংখ্যা কত? এখন তৃণমূল সবচেয়ে বড় দল। তারপর সিপিএম, কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, সিপিআই, এসইউসি ছাড়াও কিছু দল আছে যারা রাজনীতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে। তা এসব দল থেকে একটা তালিকা তৈরি করলে কতজন রাজনৈতিক নেতার সন্ধান পাওয়া যাবে? মাঝে মাঝে এরকম প্রশ্ন মনে আসে। আসার কারণঃ এ রাজনৈতিক নেতারা যা ভাবেন, তাই আমাদের ভাবতে হয়, এরা যে সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই মেনে চলতে হয়। পাঁচ বছরের জন্য আমরা এ কাজ করার অধিকার ওদের দিই নির্বাচনের মাধ্যমে। অবশ্য এখন যা পরিস্থিতি, তাতে ওই দেওয়াটাও আমাদের হাতে নেই। রাজনৈতিক নেতারা দুই রকমের। একদল যাদের হাতে শাসনক্ষমতা আছে, অন্যদল ঠুঁটো জগন্নাথ। দ্বিতীয় দল বাধ্য হলে চিৎকার-চেঁচামেচি করেন, নইলে চুপ করে থাকাই নিরাপদ ভাবেন। ওই চেঁচামেচি করতে হয় নইলে নিজেদের অস্তিত্ব মানুষকে জানানো যায় না। এরা রাজনৈতিক নেতা হলেও এদের সিদ্ধান্ত মেনে চলার দরকার নেই। কারণ এরা আইন তৈরি করতে পারেন না, বেআইনি কাজ করলে পুলিশ এদের সমর্থন করে না। অতএব, আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে সব অর্থে নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারা। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ, যাদের জনসাধারণ বলা হয়, এই আমরা, জেনে গেছি কীভাবে জীবনযাপন করতে হয়। এ ব্যাপারে আমাদের পথপ্রদর্শক পাঁকাল মাছ। পাঁকের মধ্যে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে, অন্য মাছের মতো জলে ভেসে বেড়ায় না, তাই সহজে জেলের জালে ধরা পড়ে না। আমরা যারা সাধারণ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকি, তারা কতগুলো ব্যাপারে বিস্তর জ্ঞান সঞ্চয়ন করেছি। যেমন, কোনো রাজনৈতিক নেতা যদি ক্ষিপ্ত হয়ে অশ্লীল গালাগাল করে ফেলেন, তা না শোনার ভান করি। পাড়ার রকে বসে যেসব রকবাজ অকাতরে অশ্লীল কথা বলে যায় এবং তা আমাদের কানে গেলেও মরমে ঢোকাই নাঃ ঠিক সেরকম একটা কায়দা আমরা আয়ত্ত করে ফেলেছি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দাদাদের গোষ্ঠীবিরোধ হলে আমরা চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকি, যেন কিছুই ঘটছে না। বিরোধী দলের নেতা যখন শাসক দলের সাংসদের সঙ্গে গলা জড়িয়ে ধরে গরুর মাংস ভক্ষণ করেন তখন ভেবে নিই ‘ভ্রান্তিবিলাস’ দেখছি। আমরা শুধু নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকতে চাই। ডিজেলের দাম বাড়লে বাসের মালিকরা ভাড়া বাড়াতে চায়, রাজনৈতিক নেতারা তাদের সঙ্গে দর কষাকষি করেন, আমরা ছাগলছানার মতো তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। শ্যামবাজার থেকে ডালহৌসি যেতে যদি দুই টাকা ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয় তাহলে বউবাজারের মোড়ে বাস থেকে নেমে হেঁটে যাই। তাতে আগের ভাড়াতেই কাজ হয়ে যায়। বাড়তি দুই টাকার জন্য দুশ্চিন্তা করতে হয় না। যেতে আসতে চার টাকা। মানে মাসে প্রায় ৯৯ টাকা বেশি আর দিতে হলো না। বদলে একটু হাঁটাহাঁটি হলো। আমরা জেনে গিয়েছি সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের কী কী করা উচিত। বাঁচতে হলে কিছু ফন্দি শিখতে হবে। যখন বাজার না করলে না খেয়ে মরতে হবে। সেখানে যাওয়ার সময় গিন্নি বলেন, এটা এনো, সেটা এনো। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে আর আবদার রাখতে হিমশিম খেতে হয়। মাইনের যে টাকা বাজারের জন্য খামে রাখা আছে, তা ১৫ দিনেই খতম হয়ে যাবে। পুজোর আগে ইলিশের আবদার হয়েছিল। এক কেজি ১২০০ টাকায় কেনার চেয়ে ডেঙ্গু হওয়া ঢের ভালো। সত্তর গ্রামের একটা পিসের দাম পড়বে ১২০ টাকা। হজম হবে না। কিন্তু আড়াইশ গ্রামের ইলিশ ৪০০ টাকা কেজিতে পাওয়া যায়। তাই কিনে টুকরা করিয়ে নিয়ে এলে গিন্নি চেঁচাবেন, বড্ড কাঁটা, আর ইলিশ আনতে হবে না। ব্যালেন্স রাখতে আগে যে আলু এক কেজি কেনা হতো এখন তা ৯০০ নিয়ে এলে গিন্নি টের পাবেন না। এ চালাকি নিশ্চয়ই নিজের সঙ্গে করতে হচ্ছে। কিন্তু না করলে সীমিত আয়ে বেঁচে থাকার উপায় নেই। এখন মানুষ ভুলে গেছে তার কী করা উচিত। সে জেনেছে, নির্বাচন এলে বক্তৃতা শুনতে যেতে হবে কিন্তু রাজনৈতিক দলের নেতাদের চেলারা ভোট দিতে যেতে নিষেধ করলে ঘরে বসে টিভি দেখতে হবে। এখন নিজের এবং পরিবারের বাইরে আর কোনো কিছু নিয়ে ভাবাটা বিলাসিতা। তার ফল খারাপ হতে বাধ্য। পুজোর ছুটির সময় যখন করপোরেশন বন্ধ, তখন যদি দিন-রাত এক করে কোনো রাজনৈতিক নেতার কেনা দোতলা বাড়িকে তেতলা করে ফেলে প্ল্যান ছাড়াই, তা দেখেও না দেখার মতো মুখ করে বসে থাকতে হবে।

সেদিন হঠাৎই একজন প্রাক্তন সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হলো। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বয়স তো হয়েছে, দীক্ষা নিয়েছেন?’

আমি হেসে ফেললাম, ‘এখনো প্রয়োজন হয়নি।’

‘আমি নিয়েছি।’ ভদ্রলোক বললেন।

‘আপনার নিশ্চয়ই প্রয়োজন হয়েছে।’

‘হ্যাঁ, জিনিসপত্রের যা দাম আর পেরে উঠছিলাম না। আমরা যে গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছি তার শিষ্যদের মাছ, মাংস, ডিম, পিয়াজ, রসুন খাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ। উঃ কী বিপুল খরচ বেঁচে গেছে মশাই।’ ভদ্রলোক বললেন। এটাও বেঁচে থাকার একটি ফন্দি। রাজনৈতিক নেতাদের এ কারণে দীক্ষা নিতে হয় না। সাধারণ মানুষের হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের সমস্যা বাড়ায় এ খবরের কাগজগুলো। তারা এমন সব খবর ছাপে যে, এত কায়দা করে বেঁচে থাকা মানুষের ঘুম উঠে যায়। ফোন এলো, ‘আচ্ছা, সরকারের নাকি এক কোটি টাকা ধার হয়ে গেছে। এরপর দেউলিয়া হয়ে গেলে আমাদের মাইনে দিতে পারবে না, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাও চোট হয়ে যাবে। কাগজে লিখেছে। তাহলে আমাদের কী হবে বলুন তো?’

সমস্যাটা এখানেই। আমরা সরকারের কাছে সবসময় হাত পেতে থাকি, সরকারকে দিতে শিখিনি। মুষ্টিমেয় রাজনৈতিক নেতার কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো ভ‚মিকা নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর