১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ১২:০২

জঙ্গিদের বর্তমান তৎপরতা ভয়ঙ্কর

নিজস্ব প্রতিবেদক

জঙ্গিদের বর্তমান তৎপরতা ভয়ঙ্কর
অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেছেন, সাম্প্রদায়িক জঙ্গিত্বের ক্রমাগত যে ধারা, তাতে স্পষ্ট ওরা যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছে। জঙ্গিদের বর্তমান তৎপরতা ভয়ঙ্কর। আমাদের ইতিহাসে এ কোনো সাধারণ সংকট নয়, প্রকৃত অর্থেই মহাবিপর্যয় ও গভীর সংকটের এ এক ক্রান্তিকাল। তাই মৌলবাদী জঙ্গিদের নিরস্ত্র করা না গেলে সামনে বড় মাপের নতুন ধরনের বিপর্যয় ঘটবে, যা এ মুহূর্তে কল্পনাও করা যাচ্ছে না। তাই রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে যারা জঙ্গিত্বের প্রমোটার, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে ও বহিষ্কার করতে হবে। ড. আবুল বারকাত গতকাল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অর্থনীতিবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত জাতীয় সেমিনার-২০১৫ তে এ কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই শিক্ষক সেমিনারে ‘বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও জঙ্গিবাদ : মর্মার্থ ও করণীয়’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আশরাফ উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের পর সেমিনারে অংশ নেওয়া ২৪ জন শ্রোতার বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন ড. আবুল বারকাত।  
মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, মৌলবাদী অর্থনীতি আমাদের চেতনাবিরুদ্ধ। তাদের ২৩১টি বেসরকারি সংস্থার অর্থ আসে বিদেশ থেকে। মৌলবাদী আদর্শে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের এখন বার্ষিক মুনাফার পরিমাণ ২ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। আর ১৯৭৫ থেকে ২০১৪ এই ৪০ বছরে মৌলবাদের অর্থনীতির মোট পুঞ্জীভূত মুনাফার পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা। মৌলবাদী অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ। এই অর্থ দিয়ে তারা ৫ লাখ ফুলটাইম রাজনৈতিক কর্মী নিয়োগ করতে পারে। যদিও পবিত্র কোরআন শরিফে জিহাদ বলে কিছু নেই। কিন্তু মৌলবাদী-জঙ্গিরা জিহাদের নামে দেশের ১৩২টি জঙ্গি সংগঠনকে একমঞ্চে (প্লাটফর্ম) আনতে চায়। আল-কায়েদা জঙ্গিদের মূল রাজনৈতিক সংগঠন এবং আইএস তাদের মিলিট্যান্স। জঙ্গি অর্থায়নের উত্সমুখ বন্ধে ১৫ দফা সুপারিশ করতে গিয়ে মৌলবাদী অর্থনীতির শেকড়সন্ধানী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেছেন, আমাদের দেশে শান্তিপূর্ণ পথে ধর্ম প্রচার ও ধর্ম পালনের ফলে মানুষ বংশপরম্পরা ধর্মভীরু হয়েছেন, কিন্তু বক-ধার্মিক হননি। অর্থাত্ ধর্মের মূল ধারণাটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাহন হয়েছে। আর সে কারণেই মৌলবাদের অর্থনীতি ও সংশ্লিষ্ট জঙ্গিবাদ এ দেশে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ওই শক্তি ব্যবহার করে ধর্মের নামে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল সম্ভব হবে না। তবে ‘আত্মতুষ্ট হয়ে বসে থাকলে বিপদ নেই’— এমনটি ভাবার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। কারণ বিষয়টি গভীরভাবে রাজনৈতিক। অতএব লড়াইটিও রাজনৈতিক। এই লড়াইয়ে একদিকে মানবকল্যাণকামী সুফি-ওলামা মূল ধারার প্রবক্তাদের সংঘবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার লালন ও মুক্তচিন্তা এবং স্বাধীনতার ভিত্তি প্রসারে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রব্যবস্থাই হতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত মৌলবাদী অর্থনীতির ভিত্তিমূল দুর্বল করার একমাত্র পথ। ১৫ দফা সুপারিশের প্রথমটিতেই তিনি বলেন, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হওয়ার সঙ্গে কমপক্ষে পাঁচ হাজার যুদ্ধাপরাধী জড়িত আছে। আগামী পাঁচ বছরে (সম্ভব হলে) তাদের বিচার কাজ সম্পন্ন করতে ১০টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পরামর্শ তার। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ করেছেন, যারাই মৌলবাদী জঙ্গিদের গডফাদার, তাদের বিচারকাজ দ্রুত সম্পন্ন করে শাস্তি কার্যকর করা হোক। তিনি জামায়াতে ইসলামীকে মৌলবাদী ইসলামী জঙ্গিবাদের করপোরেট হেডকোয়ার্টার বলে আখ্যায়িত করেন। দ্বিতীয় সুপারিশে বলা হয়, জঙ্গিদের অর্থায়নের উত্স সম্পর্কে সরকারের যা কিছু জানা আছে, তা অতি দ্রুত গণমাধ্যমে প্রকাশ-প্রচার করা হোক। তৃতীয় সুপারিশে জঙ্গি অর্থায়নের উত্সমুখ বন্ধ করা, চতুর্থ সুপারিশে মৌলবাদের অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট (শিল্প, সংস্কৃতি ট্রাস্ট ও ফাউন্ডেশনসহ) প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে তৃতীয় পক্ষীয় অডিটের মাধ্যমে জামায়াত-জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা উদ্ঘাটন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। তিনি বলেন, এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে— জঙ্গিদের সম্পদ জাতীয়করণ, বাজেয়াপ্তকরণ, আইনি হস্তান্তর, ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন ও পর্ষদ পরিবর্তন ইত্যাদি। আবুল বারকাতের পঞ্চম সুপারিশে রয়েছে, জঙ্গিদের অস্ত্রের উত্স সম্পর্কে সরকার যা কিছু জানে, তা অতি দ্রুত গণমাধ্যমে প্রচার করা। ষষ্ঠ সুপারিশে জঙ্গিদের সংশ্লিষ্ট সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, সপ্তম সুপারিশে বাজেয়াপ্ত করা সম্পদ সরকারের তত্ত্বাবধানে এনে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও পঙ্গুত্ববরণকারী অসচ্ছল জীবনযাপন করছেন এবং পরবর্তী সময়ে মৌলবাদী জঙ্গিত্বের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদান করা। অষ্টম সুপারিশে তিনি বলেন, জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, নবম সুপারিশে বলা হয়, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী গোয়েন্দা নজরদারি সিস্টেম (ব্যবস্থা) অনেক বেশি তথ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। ১০ম সুপারিশে সরকারের জঙ্গি দমন ও ধৃত জঙ্গিদের মধ্যে জঙ্গিবিরোধী সচেতনতা পরিচালন করা। ১১তম সুপারিশে জঙ্গিদের অস্ত্রের উত্সমুখ বন্ধ করা এবং অস্ত্র উদ্ধারে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়। ড. আবুল বারকাত তার ১২তম সুপারিশে বলেন, রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে যারা জঙ্গিত্বের প্রমোটার, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও সরকার থেকে তাদের বহিষ্কার করতে হবে। ১৩তম সুপারিশে বলা হয়, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার সংগ্রাম জোরদার করতে হবে। ১৪তম সুপারিশে ধর্মীয় জঙ্গিদের প্রকৃত চেহারা উন্মোচন করে জনগণকে জঙ্গি নির্মূল প্রক্রিয়াতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে হবে। সর্বশেষ ১৫তম সুপারিশে তিনি বলেন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান কর্মসূচিকে দেশের সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংস্কার করতে হবে। সেমিনারে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক প্রশ্নের জবাবে ড. আবুল বারকাত বলেন, ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের প্রচারণায় ইসলামী ব্যাংকের ৮০ কোটি টাকা নেওয়া হয়। আমি মনে করি ইসলামী ব্যাংককে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের স্পন্সর করে সরকার ভুল করেছে। এর মাধ্যমে সরাসরি ইসলামী ব্যাংককে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তখন আমি জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে এটা ঠেকাতে সরকারকে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা ঠেকানো যায়নি। সেই সময় কিছু দিনের জন্য আমি দেশের বাইরে গিয়েছিলাম। এসে দেখি বিমানবন্দরে খেজুর গাছ আর বাতি জ্বলছে। শেরাটনের সামনে দেখলাম বিরাট এক নৌকা, তলায় লেখা সৌজন্যে ইসলামী ব্যাংক আর উপরে লেখা নৌকা আমার পরিচয়। আরও কিছু প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে খুনের পরিকল্পনা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াজ মাহফিলে টাকা উঠানো ও তার খরচ নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। কওমি মাদ্রাসায় রেজিস্ট্রেশন দরকার। এটা পাকিস্তানে আছে। কিন্তু আমাদের দেশে করতে গেলে আপত্তি করা হয়। অর্থ পাচারের সঙ্গে মৌলবাদের সম্পর্ক আছে। তাদের অনেক গোপন ব্যবসাও আছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর