২৩ ডিসেম্বর, ২০১৫ ১২:০৭

বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের কাজ কী

নঈম নিজাম

বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের কাজ কী

২০০৩ সালে চীন গিয়েছিলাম এটিএন বাংলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে। থাই এয়ারে আমাদের ফ্লাইট ঢাকা-ব্যাংকক-বেইজিং। আসা-যাওয়ার পথে ২০ ঘণ্টা যাত্রাবিরতি ব্যাংকক বিমানবন্দরে। তাড়াহুড়ার কারণে ঢাকা থেকে থাইল্যান্ডের ভিসা নিতে পারিনি। তবে মাহফুজ ভাইয়ের ভিসা আছে। মাত্র তিন দিন আগে সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে ভিসা নিলাম চীনের। এরপর সময় মেলেনি। বেইজিং পৌঁছার পর এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বললেন, থাই ভিসা নিয়ে নিন এখান থেকে। তাহলে ২০ ঘণ্টা বিমানবন্দরে বন্দী জীবন কাটাতে হবে না।  প্রস্তাবটা ভালোই মনে হলো। আমাদের সঙ্গে থাইকম স্যাটেলাইটের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন। তাকে নিয়ে গেলাম থাই দূতাবাসে। আমাদের বসিয়ে রেখে থাই স্যাটেলাইটের কর্মকর্তা কথা বললেন। দূতাবাসের কর্মকর্তারা বললেন, কোনো সমস্যা নেই। ভিসা আমরা দেব। তবে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে একটা শনাক্তকরণ পত্র নিয়ে আসতে হবে। থার্ড দেশ থেকে ভিসা নেওয়ার এটাই রেওয়াজ। শুধু লিখে দিতে হবে, আপনি বাংলাদেশের নাগরিক। অনেকটা যার জন্য প্রযোজ্য জাতীয়। থাই দূতাবাসের পাশেই বাংলাদেশ দূতাবাস। এটিএন বাংলার চেয়ারম্যানসহ গেলাম আমাদের দূতাবাসে। মাহফুজ ভাই এবং আমি ভাবে আছি। কারণ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে এতটুকু সম্মান আশা করতেই পারি। মুখোমুখি হলাম বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার। যার নাম... মান্নান। তার বাবা আওয়ামী লীগের এমপি ছিলেন। মাহফুজুর রহমান এবং আমাকে চেনেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিফ প্রটোকল ছিলেন। তখন বারবার দেখা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একদিন রবিউল আলম মুক্তাদির চৌধুরী ও আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম পরিচয় করে দিয়েছিলেন। তবুও তিনি কষ্ট করে চিনলেন। তারপর সমস্যা শুনলেন। এরপর অনেক হাইকোর্ট-জজকোর্ট দেখালেন। একপর্যায়ে কোনো ধরনের সহায়তা করতে অস্বীকার করলেন। মাহফুজুর রহমান বিস্মিত হলেন। স্পষ্টবাদী মানুষটি বলেই বসলেন, আপনি আমাদের সহায়তা না করলে কাকে করবেন? সাধারণ প্রবাসীরাও আপনাদের কাছে আসতেই পারে না। ভদ্রলোক বিনীতভাবে হাসলেন। আরেক কাপ কফি খেতে বললেন।

আমার মন খারাপ দেখে থাই স্যাটেলাইটের কর্মকর্তা হতবাক হলেন। বললেন, বিদেশে তোমাদের দূতাবাসগুলোর কাজ কী? আমি বললাম, প্রবাসী বাংলাদেশিদের সহায়তা না করা। আমাদের মন্ত্রীরা বিদেশ গেলে প্রটোকল করা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের টপ বসদের তেল মারা। থাই ভদ্রলোক কী বুঝলেন জানি না। বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, তোমাকে একটি শনাক্তকরণ চিঠি দিল না! আমি বললাম, না!। এরপর থেকে বিদেশ গেলে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে দূরে থাকি। দূতাবাসের কর্মকর্তাদের দেখলে দূর থেকে হাত নাড়ি। কাছে যাই না। নিজের পাসপোর্ট সামলে রাখি। হারিয়ে গেলে যাতে বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতে না হয়। তাদের মিষ্টি কথার হয়রানিতে না পড়তে হয়। দেখা গেল মাসের পর মাস আমি বিদেশের পথে পথে ঘুরছি। বাংলাদেশ দূতাবাস আমাকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছে, সুপ্রিমকোর্ট বুঝাচ্ছে। আর আমি হারানো পাসপোর্টের জন্য মন খারাপ করে গালে হাত দিয়ে বসে আছি। মাঝে মাঝে এখনো চিন্তা করি, মি. মান্নান ও তার সহকর্মীরা দুই লাইনের একটি প্রত্যয়নপত্র দিলে বাংলাদেশে কী প্রলয় ঘটে যেত? না চীন বন্ধ ঘোষণা করত বাংলাদেশ দূতাবাস। অথবা থাই দূতাবাস বাংলাদেশ দূতাবাসকে বড়মাপের জরিমানা করে বসত। অথবা আমি বড় কোনো অপরাধ করে বসতাম! নিজের কাছে নিজে কোনো জবাব পাইনি। তবে থাই ভদ্রলোক আমাকে নিয়ে আবার তার দেশের দূতাবাসে গেলেন। তারা বললেন, তোমার দেশের দূতাবাস তোমাকে একটি চিঠি দিল না? আশ্চর্য!

বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোর কাজ কী? মাঝে মাঝে পত্রিকায় খবরে দেখি কেলেঙ্কারি নিয়েই দূতাবাসগুলো ব্যস্ত থাকে। বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করাতে তাদের ভূমিকা নেই। সেদিন টকশোতে একজন বললেন, বিএনপি-জামায়াত বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে। তারা অপপ্রচারে লিপ্ত বাংলাদেশ নিয়ে। আমিও টকশোর আরেকজন অংশগ্রহণকারী। মন খারাপ করলাম। বললাম, বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলো কি বিলুপ্ত হয়ে গেছে? সরকার এত টাকা খরচ করে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে মিশন রেখেছে। সেখানে আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছড়াছড়ি। তারা করছে কী? প্রেস উইংগুলো বা কী করছে? ইকোনমিক, কমার্স, লেবার কাউন্সিলরদের কাজ কী? রাজনৈতিকভাবে গত সাত বছরে পররাষ্ট্র বিভাগে নিয়োগের ছড়াছড়ি। তাদের কাজ কী? বিএনপি-জামায়াত যদি সরকারের মিশনগুলোকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তাহলে এত মিশনের কী দরকার? আমার এ জবাবে খুশি হননি সরকার সমর্থক টকশোর ভাই। মন খারাপ করে পাল্টা জবাব দিলেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। বাংলাদেশ মিশনগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। শুধু দামি গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়ালে চলবে না। আমাদের মিশনগুলোকে প্রবাসীদের সব সুযোগ-সুবিধা দেখতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোকে আরও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। সরকার ও দেশের সাফল্য তুলে ধরতে হবে বিদেশে। শুধু কিছু উপহার প্রদানকারী বাংলাদেশিকে নিয়ে তাদের সময় কাটালে হবে না। খুঁজে বের করতে হবে কোন দেশে কোন প্রবাসীরা ভালো করছে। তাদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে। এড়িয়ে যেতে হবে সুযোগসন্ধানীদের। কোনো মানুষ বিপদে পড়লে তাকে সহায়তা করতে হবে।

বিদেশ গেলে আমি সব সময় প্রবাসীদের সঙ্গে সময় কাটাই, তাদের সুখ-দুঃখ শুনি। আজ অবধি কাউকে পাইনি যে প্রশংসা করেছেন আমাদের দূতাবাসের। অবশ্য সুযোগসন্ধানীর কথা আলাদা। আমাদের রাষ্ট্রদূতদের আচরণে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নেরও নজির রয়েছে। মাঝে মাঝে মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনেক সাধারণ মানুষ ফোন করেন। এর মাঝে কুমিল্লার লোক বেশি। আমার নাঙ্গলকোটের লোক হলে তো কথাই নেই। ফোন ধরতেই হয়। তারা বিদেশের মাটিতে কষ্টের কথা বলেন। দূতাবাসে গিয়ে হয়রানির কথা বলেন। সাধারণ শ্রমিকদের গুরুত্ব দেন না আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তারা।

অথচ এই শ্রমিকদের টাকায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্ত অবস্থানে। দায়িত্বশীলদের বাস্তবতায় থাকতে হবে। দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর করেন না তার কাজ। ইকোনমিক কাউন্সিলর ব্যস্ত সংস্কৃতি নিয়ে। প্রেসের দায়িত্বে যারা তারা ব্যস্ত থাকেন ডলার সেভ করা নিয়ে। কথায় কথায় একজন বললেন, বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশবিরোধী লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছে বিদেশে। ভালো কথা বলে তারা বিদেশিদের প্রভাবিত করছে। কিন্তু আমাদের মিশনগুলো করছে কী? রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয়ে আমাদের মিশনগুলো বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে না পারলে কী করার আছে? আর আমাদের কূটনীতিকদের চেয়ে বিএনপির লবিস্টরা অধিক শক্তিশালী হলে তারা ধন্যবাদ পেতে পারে। কারণ বিরোধী দলে থেকে তারা এই কাজগুলো সূক্ষ্মভাবে করতে পারছে। আর আমাদের মিশনগুলো ঘুমাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বিদেশে নানামুখী প্রচার দেখে দুঃখ হয়। অথচ সাদা চোখে বলছি, মিশনগুলো অনেক বেশি কাজ করতে পারত। অথচ মিশন প্রধানকে যখন দেখি মধ্যরাতে মোটরসাইকেলে নাইট ক্লাবে যেতে অথবা নায়িকা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে, তখন অন্য কাজের সময় কোথায়। আবার অনেক নারী কূটনীতিককে সতর্ক থাকতে হয় তাদের স্বামীকে নিয়ে। কাউকে কাউকে জরিমানাও গুনতে হয়েছে।

দূতাবাস নিয়ে সব স্মৃতি খারাপ না। ভালো কিছুও আছে। এই স্মৃতি কলকাতা মিশনে। তখন উপ-রাষ্ট্রদূত ছিলেন হুমায়ূন কবীর। তার সঙ্গে কাউন্সিলর প্রেস, তথ্য কাডারের কর্মকর্তা আবু তৈয়ব। দ্বিতীয় সচিব সরোয়ার আলম। চমত্কার একটি টিম। হোটেলে থাকতে দিলেন না আবু তৈয়ব। তার বেগ বাগানের বাড়িতে থাকলাম। আড্ডা দিতাম সরোয়ারের সঙ্গে। হাইকমিশনে উপ-রাষ্ট্রদূতের বাসায়ও গিয়েছি। তিনজনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণেই হয়তো এত আপ্যায়ন। কিন্তু দেখেছি তারা কাজ করছেন বাংলাদেশের জন্য। একদিন সরোয়ারের বাসায় কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হলো। আমিও ছিলাম। তারা কাজ করতেন। এর বিপরীতও দেখেছি বছর কয়েক আগে। ওয়াশিংটনে আনিসুর রহমান মিঠুর বাসায় গিয়েছিলাম। কুমিল্লার মিঠু ও তার স্ত্রীর কোনো তুলনা নেই অতিথি আপ্যায়নে। দুজনই আমার স্নেহভাজন। আমার স্ত্রীও তাদের পছন্দ করেন। নিউইয়র্কে অবস্থানকালে আমার স্ত্রী ফরিদা ফোন করেন প্রেস মিনিস্টারকে। তিনি ভীষণ আন্তরিক। বললেন, ওয়াশিংটন এলে যেন তাকে কল করেন। ফরিদা তাই করলেন। মিনিস্টার বললেন, আজ হলিডে। তা না হলে দেখা হতে পারত নঈম ও আপনার সঙ্গে। আমি তাকে আগেই আভাস দিয়েছিলাম, তিনি এমন কিছু বলবেন। আরেকবার নিউইয়র্ক গেলাম প্রবাসী সাংবাদিক বন্ধুদের আমন্ত্রণে একটি অনুষ্ঠানে। শ্যামল দত্ত আমাকে বললেন, মোমেন ভাই আমাদের দুজনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দুপুরে খাওয়ার জন্য। আমি গেলাম না। শ্যামলকে পাঠিয়ে দিলাম। বললাম, মোমেন ভাইকে সালাম দিস। সেবার না দেখা হলেও এই বছর ড. মোমেনের সঙ্গে একাধিক অনুষ্ঠানে নিউইয়র্কে দেখা হয়েছে। চমত্কার মানুষ। তিনি নিউইয়র্ক মাতিয়ে এখন বাংলাদেশে।  মনে মনে ভাবলাম, ড. মোমেন অথবা সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর মতো কূটনীতিক থাকলে চীনের মতো তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার হতো না।

পাদটীকা : আমার এক বন্ধু তার জীবনের ব্যর্থতার কাহিনী শোনাচ্ছিল। সব ব্যর্থতা নারীবিষয়ক। বন্ধু বলল, সবাই সাফল্যের কথা শোনায়। আমি বলব ব্যর্থতার গল্পগুলো। একবার এক পার্টিতে সুন্দরী নারীকে দেখে পছন্দ হলো আমার বন্ধুর। চোখের ভাষায় কথা হচ্ছে। একপর্যায়ে বন্ধু একটি টিস্যু পেপার পাঠালেন। সুন্দরী নারী তার ফোন নম্বর দিলেন টিস্যু পেপারে লিখে। বন্ধু এসএমএস দিলেন আপনার সঙ্গে গাড়ি আছে? নারী উত্তর দিলেন আছে। বন্ধুর উত্তেজনায় ঘাম ঝরার অবস্থা। সুন্দরী নারীর দ্রুত এগিয়ে চলা। বন্ধু এবার লিখলেন, আপনার গাড়ি ছেড়ে দিন। আমার সঙ্গে যাবেন। আমি আপনাকে নামিয়ে দেব। নারী উত্তর দিলেন সমস্যা নেই। গাড়ি ছেড়ে দিলাম। আমাকে আপনিই নামিয়ে দেবেন। বন্ধুর হূিপণ্ড ওঠানামা শুরু হয়। আহারে এই জীবনে এবার বোধহয় সব ব্যর্থতার অবসান হবে। অনুষ্ঠান শেষে সেই নারী এসে বসলেন আমাদের বন্ধুর পাশে। আহ কি চমত্কার পারফিউম! এমন নারীর অপেক্ষা স্বপ্নে করে সবাই। গাড়ি চলতে থাকে। বন্ধু মনে মনে ভাবছে কোনো একটা কফি শপে গিয়ে ঢুকবে। পাশাপাশি বসে গল্প। তারপর প্রেম শুরু। গাড়ি কিছু দূর যাওয়ার পর মেয়েটি বলল আপনার কি জায়গা আছে? বন্ধু বলল মানে? কচি খোকা কিছু বোঝ না! তবে আগে টাকাটা বের কর। এর আগে একজন এভাবে তোমার স্টাইলে আমাকে নিয়ে গিয়ে পরে টাকা না দিয়ে কেটে পড়েছিল। তোমাকে সেই সুযোগ দিচ্ছি না।  পকেটে হাত দাও। পরে মূল কাজের পর পালালেও সমস্যা নেই।

     লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর