২৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ১১:০৬
পর্যবেক্ষণ

সহিষ্ণুতার অন্তিম পরীক্ষা

নূরে আলম সিদ্দিকী

সহিষ্ণুতার অন্তিম পরীক্ষা

আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনের আঙ্গিকে ক্ষমতাসীন দল এমনকি বিরোধী জোটকেও সতর্ক করে দেওয়া যে কোনো বিবেকবান নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। এমনিতেই ক্ষমতার নির্লজ্জ প্রলোভন দেশ, জাতি, স্বাধীনতার প্রশ্নে মানুষের হূদয়ের স্পন্দনকে আদৌ উপলদ্ধি না করে প্রতিহিংসাপরায়ণতা এতটাই তীব্র হয়েছে যে, মানুষ শুধু রাজনীতি ও রাজনীতিকদের প্রতি কেবল নিরাশ, হতাশ ও বীতশ্রদ্ধই নয়, রাজনীতি ও রাজনীতিকদের কাছ থেকে শুধু মুখ ফিরিয়েই নেন নাই (দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে); তারাই যে একদিকে গণতন্ত্রকামী দেশটিকে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের গভীর অতলান্তে নিক্ষেপ করেছেন, অন্যদিকে মানুষ ও সমাজের স্বস্তি ও নিরাপত্তার বিষয়টিকে ব্যারোমিটারের তলানিতে এনে ঠেকিয়েছেন। যেসব দেশে নির্বাচন হয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত; আজকের বাংলাদেশ দেখে তারা বিস্ময়াভিভূত ও ব্যথিত হবেন এ ভেবে যে, ৭০-এর নির্বাচনে যে জাতির শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষের বিস্ময়কর ঐক্য স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে ও ছাত্রলীগের কুশলী রাজনৈতিক পদক্ষেপে যে অভূতপূর্ব স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনল— তাদের গণতান্ত্রিক মননশীলতায় দারিদ্র্যের এই উলঙ্গ প্রকাশ সম্ভব হলো কেমন করে। এই একটি প্রশ্নে সাধারণ মানুষের মনে কোনো দ্বিধা-সংকোচ নেই, দুই জোটের ক্ষমতার প্রতি উদগ্র লালসা, দুর্নীতি, দুর্বিচার; বিশেষ করে দুর্নীতির প্রতি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় সমাজের দুর্ধর্ষ দুর্নীতিবাজরা অমিত বিক্রমে, দাম্ভিকতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে সমাজে হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি করেছেন। এ কথাটি আমি বহুবার বলেছি; কিন্তু এর প্রতিকার তো দূরে থাক, রাজনীতিকদের কর্ণকুহরে আমার ফরিয়াদ পৌঁছে নাই। বরং দীপ্তিহীন আগুনের নির্দয় দহনে দগ্ধীভূত হয়ে অবলোকন করেছি— ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে/ বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে/ আমি যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে/ কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।’

আমার আজকের আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় পৌরসভা নির্বাচন। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সারা বাংলাদেশে মানুষ নির্বাচনটিকে কেন্দ্র করে উৎসাহ-উদ্দীপনা (ক্ষেত্রবিশেষে কিছু অংশের মধ্যে যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে) ও উচ্ছ্বাস সবার কাছেই প্রতিভাত করেছে যে, মানুষ গণতন্ত্র-পিয়াসী। এবারের নির্বাচনে ভোট প্রদানে মানুষের অদম্য উৎসাহ দেখে আমার মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের আরেকটি পংক্তি— ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায় এসো।/ সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, প্রাণ সুধারসে এসো’।

এবারে সর্বমোট ২৩৪টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে এবং প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন প্রশ্নে একটু পরেই আমি আসব। দুই জোটে আতি- পাতি, মহারথীদের আমি বিদগ্ধ চিত্তে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, রাজনীতিতে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার একমাত্র নিয়ামক শক্তি যখন সহনশীলতা; যার যার আঙ্গিকে দেশের কল্যাণে একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রস্তুত করা, আবার জাতীয় স্বার্থে দলীয় আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে একাট্টা হওয়া। এটা মানুষকে শুধু অনুপ্রাণিত করে না, এতখানি উদ্বেলিত করে যে, জীবন বাজি রেখে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। অন্ধকার অমানিশার বক্ষ বিদীর্ণ করে একটি আলোকোজ্জ্বল প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মির আলোকচ্ছটায় পৃথিবীকে সগৌরবে জানিয়ে দেয় এ জাতির অর্জন ও গৌরবগাথা।

এই নির্বাচনে গণতান্ত্রিক সহনশীল মানসিকতা; কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও গণতন্ত্রেও নিয়ামক শক্তি সহনশীলতা প্রদর্শন করতে পারলে দেশ মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে অনেকখানি রক্ষা পাবে। মেয়র পদ তারা যে কটাই পান, শেখ হাসিনা প্রমাণ করতে পারবেন, তার সরকার তার একচ্ছত্র আধিপত্যের মধ্যে নির্বাচন কমিশন একটি গ্রহণযোগ্য (!) নির্বাচন দিতে সক্ষম হয়েছেন। এটা জেদ বা ইগোর কথা নয়, দেশবাসী অবগত যে, তার চতুর্পার্শ্বে যারা সুদৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন তাদের অনেকেই বিধ্বস্ত বামের অপভ্রংশ। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে তারা নিশ্চিতভাবেই নিশ্চিহ্ন হবেন। এই স্তাবক, তোষামোদকারী এবং আদর্শ-বিবর্জিত বামেরা শেখ হাসিনাকে কুমন্ত্রণা দিচ্ছে যে, কোনোভাবেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেয়র পদ বিরোধী জোটকে দেওয়া যাবে না। তাহলে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি সোচ্চার ও শক্তিশালী হবে। তবে দেশবাসী মনে করে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে গণতন্ত্র প্রাথমিক ভিত্তি পাবে।

নির্বাচন কমিশনের অবস্থা এতটাই করুণ যে, তারা শক্ত ও নিরপেক্ষ থাকতে পারবেন— এটা কেউই বিশ্বাস করেন না। তিনি ইতিমধ্যেই তার পক্ষপাতিত্বের অসংখ্য দৃষ্টান্ত প্রতিস্থাপন করেছেন। সরকারি জোটের অনেকেই তাকে মেরুদণ্ডহীন আখ্যায়িত করেছেন। এমনকি ক্ষমতাসীন জোটের এরশাদ তাকে ‘ভাঁড়’ বলেছেন। একটা উদাহরণ এখানে প্রাসঙ্গিক, বিরোধী জোট পৌর নির্বাচনের আগে ক্ষেত্রবিশেষে সামরিক বাহিনী প্রদানের দাবি তুলেছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেটাকে তো আমলে নেননি বরং জ্যোতিষীর মতো ভবিষ্যতকে নির্বিঘ্নে অবলোকন করে বলেছেন, সেনা নিয়োগের প্রয়োজন নেই। ভাবখানা, তিনি ভবিষ্যতবাণী করার অলৌকিক শক্তির অধিকারী। এটা পৌর নির্বাচন হতে পারে, কিন্তু এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও সফল করার সব দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতার মানদণ্ড। একটু জটিল সিদ্ধান্ত আসলেই তিনি অপ্রতিরোধ্য শক্তির অধিকারী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চান লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে। এতে বিরোধী জোটের জন্য প্রমাণ করতে সহজ হয় যে, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ও শক্তিধর তো নয়ই, বরং এটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গসংগঠন হিসেবে কাজ করছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কিছু কিছু অপ্রতিরোধ্য প্রতিষ্ঠান থাকে যাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শীর্ষ নেতৃত্বও সমীহ করেন। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের সিবিআই এবং তাদের বিচারব্যবস্থা আজ পর্যন্ত সগৌরবে এমনভাবে প্রতিস্থাপিত যে, প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় সরকার তাদের প্রভাবিত করতে পারেন না। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা সেখানে সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। আমেরিকায়ও আইআরএস ও তাদের অভ্যন্তরীণ একটি সেল আছে যাকে নির্বাচিত মহাশক্তিধর রাষ্ট্রপতিকেও সমীহ করে চলতে হয়। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানিসহ সব মুক্তবিশ্বে একেকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যা ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিরোধ করতে সক্ষম। এত কথাতেই বা যাই কেন, অনেকটা গৃহযুদ্ধের আজ পাকিস্তানের সামাজিক অবস্থা। জন্মলগ্ন থেকেই দেশটিতে বেসামরিক ও সামরিক জান্তা গণভিত্তিক রাজনীতি গড়ে উঠতে দেয়নি। তাই সেখানে সামাজিক বিপর্যয় ও দৈন্যদশা লেগেই আছে। তবুও সেখানে কায়ানির মতো প্রধান বিচারপতিকে আইয়ুব খানের মতো মহাশক্তিধরও ভয় পেতেন। সম্প্রতি পাকিস্তানে প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মোহাম্মদ চৌধুরীর হস্তক্ষেপের কারণে জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। পাকিস্তানি দখল দারিত্বের আমলে প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ পড়াননি। প্রধান বিচারপতি মোর্শেদ সাহেব ও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নির্ভীকতার প্রতীক ছিলেন। স্বাধীনতার পরও বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার ঘাটতি ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের অভিশংসন আইনটি বিচার ব্যবস্থাকে লণ্ডভণ্ড করে দিল। রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের শেষ আশ্রয়স্থল প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল।

আমাকে ভুল বোঝার অবকাশ না রাখার লক্ষ্যে আমি জনান্তিকে জানিয়ে রাখি, একমাত্র সেনাবাহিনী সার্বভৌমত্বের প্রতীক এবং দলমতের ঊর্ধ্বে। দেশের মানুষেরও তাদের নিরপেক্ষতার প্রশ্নে বিশ্বাস ও আস্থা প্রগাঢ়। আমি তাদের সঙ্গে একমত, যারা বলছেন, পুলিশসহ প্রশাসনের অংশ সবসময়ই সরকারের কাছে অনুগত থাকতে বাধ্য। অভিশংসন আইনের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তবুও বিরোধী রাজনৈতিক জোটের কাছে আমার বক্তব্য কোনো অজুহাতেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন না (৫ জানুয়ারির নির্বাচনটিকে আমি অদ্যাবধি সমর্থন করি না)। বিস্মৃত হবেন না, আজকে যে দলীয়করণ, দুর্নীতি ও দুর্বিচার— সেটির প্রসূতিকাগার ‘হাওয়া ভবন’। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের নৃশংসতার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল। যদিও এটি বাস্তব, দলছুট ও সুবিধাবাদীদের দ্বারা গড়ে ওঠা বিএনপির পক্ষে তাদের কোনো আন্দোলনের সঙ্গেই তারা জনসম্পৃক্ততা তৈরি করতে পারেননি। তবুও পৌর নির্বাচনে তাদের কর্মীদের মধ্যে যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে, রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে হলে সেটাকে তাদের ধরে রাখতে হবে। আমি আগেও বলেছি যে, খালেদা জিয়াকে নিঃসংশয় চিত্তে ঘোষণা দিতে হবে যে, তিনি এবং তার পরিবার কোনোভাবেই ক্ষমতায় আসীন হবেন না। নইলে তোতাপাখির মতো তিনি এবং তার স্তাবক, মোসাহেবরা গণতন্ত্র উদ্ধারে যে বক্তব্যটির চর্বিতচর্বণ করছেন, তা মানুষ শুনছে কিন্তু বিশ্বাস করছে না। অধিকার কখনো অনুনয়, বিনয় বা ভিক্ষা চেয়ে পাওয়া যায় না। বোমা বিস্ফোরণ বা মানুষ হত্যার মধ্য দিয়েও সেটি আসে না। মানুষহত্যা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে বরং সেটি বুমেরাং হয়। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেগম খালেদা জিয়ার লক্ষ্য হওয়া উচিত, প্রতিটি সাংগঠনিক জেলা থেকে স্বেচ্ছাকারাবরণ ও নির্যাতন-নিগ্রহ মোকাবিলা করার মতো মৃত্যুভয়কে পরোয়া না করা অকুতোভয় অন্তত ৫০০ কর্মী খুঁজে বের করা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের বিস্তৃত পথপরিক্রমণে— বিশেষ করে ৬ দফা প্রদানের পর যে চেতনার গৌরবগাথায় বঙ্গবন্ধু তার অসাধারণ নেতৃত্বে সমগ্র জাতিকে একটি মিলনের মোহনায় এনে দাঁড় করিয়েছিলেন, সেখান থেকে অন্তত কিছু শিক্ষাগ্রহণ করুন।

এই পৌর নির্বাচন দেশে গণতন্ত্র বিন্দুমাত্র থাকবে কি থাকবে না— তারই অগ্নিপরীক্ষা। গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকারবিহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা সমাজে দুর্বিচার ও দুর্নীতিপরায়ণদের দৌরাত্ম্য বাড়ায় এবং সামাজিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি করে। দুই নেত্রী এই প্রশ্নে সতর্ক ও নিষ্ঠাবান থাকবেন— এটিই জাতির প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর