২৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ১৩:২৪
লেখকের অন্য চোখ

চাকরি ছেড়ে হোলটাইমার লেখক হয়ে গেলাম

সমরেশ মজুমদার

চাকরি ছেড়ে হোলটাইমার লেখক হয়ে গেলাম

চুরাশি সালের এক রাতে দিল্লির সাহিত্য একাডেমির পুরস্কারটা যখন আমার নামে ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন খুব লজ্জায় পড়েছিলাম। আমার চেয়ে দশ পনেরো কুড়ি বছর বেশি লিখছেন, এমন অনেক বিখ্যাত লেখক তখনো একাডেমি পাননি। অথচ আমার প্রথম উপন্যাস বেরিয়েছে নয় বছর আগে, দৌড়। তারপর সম্বল বললে উত্তরাধিকার এবং কালবেলা। আমাকে বলা হয়েছিল, কোনো লেখকের সারা জীবনের সাহিত্যকর্মের জন্য নয়, সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয় গত কয়েক বছরের মধ্যে লেখা কোনো বিশেষ বইয়ের জন্য। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কালবেলা কী করে বিশেষের পর্যায়ে পড়ল। আমার বন্ধুরা বলে থাকেন, আমি জলপাইগুড়িকে সম্বল করে উত্তরাধিকার লিখেছি, নকশাল আন্দোলনকে পুঁজি করে কালবেলা। যেহেতু নকশাল আন্দোলনের পটভূমিকায় তখনো পর্যন্ত কেউ উপন্যাস লেখেননি, লিখলেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি, তাই কালবেলা পুরস্কৃত হয়েছিল। কিন্তু আজও বিস্ময় কাটল না। সে সময় এরকম একটা পুরস্কার কারও জীবনকে বদলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। যে কোনো দিন গল্প-উপন্যাস পড়ে না সেও খবরের কাগজের খবর পড়ে বলতে লাগল, আপনি তো এখন সেলিব্রেটি। নর্থবেঙ্গল থেকে আপনার আগে কেউ পেয়েছেন? যারা একটু বই নাড়াচাড়া করেন, তারা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অমিয়ভূষণ মজুমদার বোধহয় পুরস্কৃত হয়েছিলেন, তাই না?’ কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, যে বই গত ছয় মাসে একশ কপি বিক্রি হয়েছিল তা একবারে পাঁচশ ছাড়িয়ে গেল। তারপর তিরিশ বছর ধরে একটানা চলছে। কথাগুলো বলার কারণ হলো, তখন মানুষ পুরস্কারগুলোকে সম্মান করত। ফলে পুরস্কৃত বই সংগ্রহে রাখার প্রবণতা থাকত। কিন্তু ধীরে ধীরে পুরস্কার তার মহিমা হারাল যখন লোকে জানল পুরস্কার পাইয়ে দেওয়া হয়। গত দশ বছরে আমি দুইবার সাহিত্য একাডেমির জুরি ছিলাম। দুইজন জুরি প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা বইগুলো পড়ে একটিকে পুরস্কৃত করেন। দ্বিতীয়বারে যেদিন আমরা সিদ্ধান্ত নেব সেদিন আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় প্রবীণতম কবি ফোন করে বললেন, ‘হ্যাঁরে, একটা অনুরোধ রাখবি?’ এরপর তিনি একজন কবির নাম বলে অনুরোধ করলেন, ‘ওর বই প্রাথমিকের তালিকায় আছে। বেচারার স্ত্রী মারা গেছে। খুব কষ্টে আছে। এবার ওকেই পুরস্কারটা দে।’  কারও স্ত্রী মারা গেলে যে পুরস্কারের যোগ্য হবে এমন কথা কখনো শুনিনি। বলাবাহুল্য, ওই অনুরোধ রাখতে পারিনি। কিন্তু পরের বছর কাগজে পড়লাম, সেই কবিকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। মৃত স্ত্রীর কল্যাণে তিনি সত্যি ভাগ্যবান। পাঠক মূর্খ নয়, এসব দেখেশুনে তারাও বুঝে গেছেন আর এই পুরস্কারগুলোর ওপর আস্থা রাখা যায় না। শুধু সাহিত্য পুরস্কার কেন, বিশ্ববিদ্যালয় যে ডি-লিট দেয় তাও ক্রমশ খেলো হয়ে যাচ্ছে। কাগজে পড়লাম একদা প্রভাবশালী মন্ত্রীর সৌজন্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কারা ডি-লিট পাবেন ঘোষণা করার পরেও আবার নতুন করে মিটিং করে একদিন আগে কবিকে ডি-লিট দিতে বাধ্য হয়েছেন। এই ধরনের ডি-লিট উপাধির কী মূল্য আছে? সাহিত্য একাডেমির পুরস্কার পাওয়ার পর মনে হয়েছিল, এবার যে দায়িত্ব কাঁধে চাপল তাকে সম্মান করা উচিত। চাকরি ছেড়ে দিয়ে হোলটাইমার লেখক হয়ে গেলাম। আমার আগে একমাত্র সমরেশ বসু দীর্ঘকাল কোনো চাকরি না করে শুধু লেখালেখি করে যে ভালোভাবে বেঁচে থাকা যায় তা প্রমাণ করেছিলেন। বন্ধুরা বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষায় লেখালেখি করে সমরেশ বসু বেঁচেছিলেন বটে কিন্তু পরে তাকে মহানগর পত্রিকার সম্পাদকের চাকরি নিতে হয়েছিল। এরকম ভুল করো না।’

তারা ঠিক কথাই বলেছিলেন, বাংলা বই আর কত বিক্রি হতে পারে? আবার বিক্রি যা হয়েছে বা হয় তার সঠিক সংখ্যা কি প্রকাশকরা লেখককে বলবেন? একজন প্রকাশক তো স্বীকার করলেন, ‘আমি ব্যবসা করতে বসেছি। ধরুন দুইজন লেখকের দুটো বই ছাপলাম। প্রতিটির খরচ হলো তিরিশ হাজার টাকা। বিক্রির সময় দেখলাম একজনের বই বছরে দুহাজার কপি বিক্রি হয়ে গেল। ওই বইয়ের পিছনে যা খরচ হয়েছে তা উঠে গিয়ে বেশ কিছু লাভ হলো। এবার লেখককে টাকা দিতে গিয়ে দেখলাম দ্বিতীয় বইটি মাত্র দুশটি বিক্রি হয়েছে। ওই বই ছাপতে যে তিরিশ হাজার খরচ হয়েছিল তার চারভাগের একভাগ মাত্র উঠেছে। বাকি তিনভাগ ক্ষতি আমি মেটাব কী করে! তাই প্রথম বইয়ের লেখককে মিথ্যা বলতে হলো। বললাম, আপনার বই এক হাজার বিক্রি হয়েছে। হাজার কপি বিক্রি হলে লেখকের যা প্রাপ্য হয় তা তাকে দিয়ে দিলাম। যে টাকাটা চেপে গেলাম তা দিয়ে খানিকটা ক্ষতি কমালাম। এক নম্বর বই যত বিক্রি হবে তত দুই নম্বরের ক্ষতি দূর হবে। তারপর যখন ক্ষতি থাকবে না তখন অভ্যাসে এক নম্বরের লেখককে বিক্রি কমিয়ে বলে যাব। কিছু করার নেই।’

কিন্তু কোনো কোনো প্রকাশক যে এই পথে হাঁটেন না তার প্রমাণ পেয়েছি। আমার ভাগ্যে এরকম একজনকে পেয়েছিলাম বলে চাকরি না করেও বিপদে পড়িনি। ক্রমশ কলকাতার পত্রপত্রিকা, প্রকাশকদের পাশাপাশি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়ও আমাদের চাহিদা হলো। মোটামুটি পঁচাশি থেকে দুহাজার সাল পর্যন্ত কলেজ স্ট্রিটের বই প্রচুর পরিমাণে বাংলাদেশে যেত। এই ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন পার্ল পাবলিকেশনের আলতাফ হোসেন মেনু। তারপর পাইরেটদের রাজত্ব শুরু হয়ে যাওয়ায় এই বই রপ্তানির ব্যবসা মার খেল। সেই বইয়ের জন্য বিজ্ঞাপনের খরচ নেই, লেখককে দক্ষিণা দিতে হয় না, নিয়ে যাওয়ার খরচ নেই। ফলে কলকাতায় বইয়ের দামের চেয়ে অনেক কম দাম তারা ধার্য করে। বিক্রেতাকে বেশি কমিশন দেয়। ফলে দোকানদার বিক্রেতারাও বেশি লাভের জন্য বেআইনি বই বিক্রি করতে আগ্রহী। এরপরে যে সমস্যা দেখা দিল, সেটা কেউ ভাবেনি। বেআইনি বইগুলো বর্ডার পেরিয়ে ভারতীয় সীমান্তের এপাশে থাকা ভারতীয় বইয়ের দোকানে পৌঁছে যাচ্ছিল। ধরপাকড় করে এখন কতটা কমানো গেছে তা জানি না। কালবেলার কারণে আমাকে আর বিব্রত জীবনযাপন করতে হয়নি। কিন্তু জীবন বাঁক নিল অন্যদিকে। ইউনাইটেড স্টেট?স ইনফরমেশন সার্ভিসের সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন করলেন, ‘সমরেশ, একটি বঙ্গসন্তান দারুণ সাহসী উদ্যোগ নিচ্ছে। তুমি যদি তার সঙ্গী হও তাহলে আমি খুব খুশি হবো। কালই চলে এসো। বিশদে বলব।’

‘সাহসী লোকটির নাম কী?’

‘জোছন দস্তিদার।’

এরপর থেকে টানা আঠারো বছর আমার গতিটি দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল। সকালে আমি লেখক, দুপুরের পর থেকে প্রযোজক।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর