৪ জানুয়ারি, ২০১৬ ১১:৪৫
পর্যবেক্ষণ

পরাজিত হয় না জনগণ

আমীর খসরু

পরাজিত হয় না জনগণ

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিতের রক্ষাকবচ হিসেবেই প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বশীলতার অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্র ব্যবস্থাটির ওপরে সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব। বর্তমানের গণপ্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে, রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকতর বিকেন্দ্রায়ন। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা বিকেন্দ্রায়নের মাধ্যমে সমাজের ওপর থেকে নিচ এবং কেন্দ্র থেকে তৃণমূল, সব স্তরে গণতন্ত্রের হাত ধরে উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে এর উল্টোটি। পুরো শাসন ব্যবস্থাটি করে তোলা হয়েছে ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত। আর কেন্দ্রীভূত শাসনের মধ্যদিয়ে যে কর্তৃত্ববাদী শাসনের জন্ম নেয় কিংবা কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাটি শাসনকে অধিকতর কেন্দ্রীভূত করে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাটিকে এ কারণেই ক্রমাগত কোণঠাসা করা হচ্ছে।

পৌরসভা নির্বাচনসহ পুরো স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নির্বাচনকে দলীয় মনোনয়ন এবং প্রতীকে রূপান্তরের মধ্যদিয়ে প্রথম যে দুর্বলতাটি প্রকাশ পেয়েছে তা হচ্ছে— এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতার্থে এবং বাস্তবে বিশাল সংখ্যক মানুষকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। এ কথাটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবারই আস্থা ও বিশ্বাস থাকবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত বা বিদ্যমান অপরাপর রাজনৈতিক দলের ওপরে। এদের ওপরে যাদের আস্থা ও বিশ্বাস নেই কিংবা যারা দলনিরপেক্ষ মানুষদের নির্বাচনে বিজয়ী দেখতে চান স্থানীয় সরকারে, তাদেরও জোর করে ওই ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে এই জোর এবং প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাটি কেন? এর পেছনে বড় ধরনের মতলববাজি কাজ করেছে। আর সে মতলববাজিটি হচ্ছে— কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থাকে তৃণমূল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। পৌরসভা নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে জোর গলায় বলা হচ্ছে। এই ‘শান্তিপূর্ণ’ শব্দের অর্থ খুঁজে পাওয়া এই দুর্ভাগা দেশে খুবই মুশকিল। তবে সামগ্রিকভাবে যা দেখা গেছে তাতে বলা যায়— ‘শান্তিপূর্ণ উপায়ে ব্যাপক কারচুপি এবং ভোট লুণ্ঠন’-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই অবিশ্বাস্য এবং নজিরবিহীন শান্তিপূর্ণ হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের সহযোগিতার বিষয়টি যেমন আছে, তেমনি বিরোধী দলও প্রতিরোধের সেই শক্তি ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। বাইরে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজিত রেখে ভিতরে কী হয়েছে তা বিচার-বিশ্লেষণ না করলে নির্বাচনটিকে অতিঅবশ্যই শান্তিপূর্ণ বলতে হবে। আর শান্তিপূর্ণ না হলে বেলা আড়াইটার মধ্যে নির্বিঘ্নে ভোট গণনা শুরু হয় কীভাবে? আগের দিন রাতে সিল মারার অভিযোগ ওঠে কেমন করে? আর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত অবাধে সিল মারার দৃশ্যই বা কোথা থেকে এসেছে? শান্তিপূর্ণ যদি হয়েই থাকে তাহলে এত অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগই বা উঠছে কেন? ভোটারের ভোটদানের যে ক্ষতিয়ান আমরা পাই তাতে ৭৪টি পৌরসভায় ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়া কতটা বাস্তবসম্মত। এই নির্বাচনে ৭৩ দশমিক ৯২ শতাংশ ভোট পড়েছে। ২০১৪-এর মে মাসে অনুষ্ঠিত প্রশ্নবোধক উপজেলা নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬৩ শতাংশের মতো। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ব্যাপক ভোট কারচুপি প্রত্যক্ষ করা গেলেও ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয়েছে ৪৪ শতাংশ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, যেসব জাতীয় নির্বাচন অর্থাত্ সংসদ নির্বাচনে সত্যিকার অর্থেই ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পেরেছেন সেসব নির্বাচনের ভোটারের ভোটদানের হিসাব যদি দেখা যায় তাহলে নিশ্চয়ই গরমিলটি খুঁজে পাওয়া যাবে। ১৯৯১-এর নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৫৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ১৯৯৬-এর নির্বাচনে ছিল ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। ২০০১-এর নির্বাচনে ছিল ৭৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং ২০০৮-এর নির্বাচনে ছিল ৮৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। তাহলে এ প্রশ্নটি উত্থাপন কি জরুরি নয় যে, ওই সব জাতীয় নির্বাচনের চাইতেও বেশি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য হয়েছে এই পৌরসভা নির্বাচনটি? ভোটারের সংখ্যাও কি বেশি ছিল? এই নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন নয়, সামগ্রিক নির্বাচন ব্যবস্থাটিরই চরম এবং সীমাহীন ক্ষতি হয়ে গেছে। কারও কারও কাছে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাটিই অর্থহীন মনে হতে পারে। তবে বর্তমান সরকারের অধীনে ভবিষ্যতে যে কোনো নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার প্রশ্নটি অর্থহীন বলে একটি ধারণার জন্ম ইতিমধ্যেই হয়েছে। এটা শুধু বিরোধী পক্ষের মধ্যেই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিস্তারিত হচ্ছে। অবশ্য বর্তমান ক্ষমতাসীনরা এটাই বরাবর চেয়ে এসেছে। ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন থেকেই ক্ষমতাসীনরা সাধারণ্যের মনোজগতে এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক ধারণার জন্ম দিতে চায় যে, ভোটের আর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন উন্নয়নের। তাদের মনে ধারণাটি তৈরি হয়েছে ভিন্ন এক মনস্তাত্ত্বিক কারণে। আর তা হচ্ছে— ক্ষমতার বাইরে গেলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তেমনই এক ভয়াবহ ভীতি। এই ভীতিই জন্ম দিয়েছে নির্বাচনী সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করার। তবে বিএনপির জন্য এই নির্বাচনের শিক্ষা হচ্ছে এই যে, নির্বাচন বয়কট আসলে প্রতিবাদ জানানোর কোনো পন্থা নয়। কারণ আপাত পরাজিত হলেও কার্যত দলটি শক্তপোক্ত একটি ভিত্তি পায়। তবে এই নির্বাচনী সংস্কৃতি শুধু ক্ষমতাসীনদের ক্ষেত্রেই নয়, সামগ্রিকভাবে রাজনীতির জন্যও বেশ কয়েকটি ক্ষতির কারণ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ পুরো প্রশাসনের ওপরে যে ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা তা ভবিষ্যতে আরও প্রকট হবে এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের শাসনের জন্য পুরো বিষয়টি হয়ে দাঁড়াবে সমস্যাসংকুল। এ ছাড়া এই নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু নির্বাচনে কারচুপিই নয়, রাজনৈতিক সাংঘর্ষিক বৈরিতার বিষয়টি তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়া এবং বিস্তৃত করা হয়েছে। এই নির্বাচন সমাজে অন্তর্গত অস্থিরতা, ভারসাম্যহীনতা ও পরিণামে রাজনৈতিক শূন্যতাকে আরও প্রকট এবং ভয়ঙ্কর করে তুলবে। এর ফলে তৃণমূল পর্যায়েও উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ এবং চরমপন্থার বিস্তার লাভ সহজতর হতে পারে। যারা সংক্ষুব্ধ, বিক্ষুব্ধ, বিতাড়িত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের মধ্যে সৃষ্ট প্রতিরোধ-প্রতিহিংসার মনোবৃত্তি যে সুস্থ, স্বাভাবিক পথে হবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ সুস্থ রাজনৈতিক পন্থার অনুপস্থিতিই উগ্রপন্থার জন্ম দেয়। তবে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, সরকারের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা বিস্তারের যে ধরন-ধারণ দেখা যাচ্ছে তাতে এ কথাটিই মনে হচ্ছে যে, ভবিষ্যতে এটি আরও তীব্রতর হবে। ক্ষমতাশ্রয়ী ক্ষমতাবান ও শক্তিমান যে শ্রেণিটির উত্থান ঘটেছে তৃণমূল পর্যন্ত, তারা আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। আর এই ধারায় ক্ষমতাসীনরা আরও বেশি নির্যাতন-নিপীড়নের পথে যাবে— তার সব আলামত স্পষ্ট। ক্ষমতাসীনদের মনে এ ধারণাটি বদ্ধমূল হয়েছে যে, তাদের প্রভাব, কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ ক্রমাগত জোরদার হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোটাই কিন্তু ঘটছে। পৌর নির্বাচন আবারও প্রমাণ করেছে যে, নির্বাচনী ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে জনগণই আপাতত পরাজিত হয়েছে। তবে বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি নয়। যুগ-যুগান্তরের শিক্ষা হচ্ছে— পরাজিত হয় না জনগণ এবং তাদের অধিকার। 

আমীর খসরু, সম্পাদক, আমাদের বুধবার ডটকম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর