১৩ জানুয়ারি, ২০১৬ ০৯:৫২
দিল্লির চিঠি

ক্ষমতার জায়গা ছেড়ে দেওয়ার ভদ্রতা

এম জে আকবর

ক্ষমতার জায়গা ছেড়ে দেওয়ার ভদ্রতা

মিথ্যে অপমানবোধের ভণ্ডামির আশ্রয় না নিয়ে কিংবা ‘কত ভালো মানুষ আমি’ তা দুনিয়াকে শোনানোর জন্য ভাষণ না দিয়ে যিনি নিজের কাছে সৎ থাকেন, নতুন বছর বরণের জন্য তার উদ্দেশে হর্ষধ্বনি করার চাইতে ভালো উপায় আর  কিছুই নয়। কাজেই আসুন আমরা ব্যাট উঁচিয়ে হাশিম আমলাকে (তিনি এখন দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দলের সাবেক ক্যাপ্টেন) অভিবাদন জানাই। ক্যাপ্টেন হওয়ার স্বপ্ন বিরাট একটি স্বপ্ন। সেই স্বপ্নময় ক্যাপ্টেন পদ ছেড়ে দিলেন আমলা। পদত্যাগের কোনো দাবি ওঠেনি। তবুও ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড হিসেবে তার যে কর্তব্য, ক্যাপ্টেনসির গুরুভার সেই কর্তব্য পালনে বাধার কারণ হয়ে ওঠে। তাই তিনি বিদায় নিলেন। ক্রিকেট ক্যাপ্টেনদের অধিকাংশই ব্যাটসম্যান হয়ে থাকেন। খেলায় যারা উচ্চমার্গের ব্যাটিং নৈপুণ্য শুধু তাদের কব্জায় বলেই এমন হয়, তা কিন্তু নয়। বোলিং অনেক কঠিন কাজ, অনেক বেদনাবহ ব্যাপার অথচ এতে জাঁকজমক কম। বোলার-ক্যাপ্টেন হিসেবে বিখ্যাত ও সম্মানিতদের মধ্যে মনে পড়ছে অস্ট্রেলিয়ার রিচি বেনো এবং ভারতের কপিল দেবকে। অলরাউন্ডার। ক্যাপ্টেন হিসেবে সুখ্যাত ইয়ান বোথাম ও ইমরান খান। টানা চলতে থাকা খেলার সার্বিক ব্যবস্থা তদারকির বেলায় ব্যাটসম্যানের উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি উপকারদায়ক বলে গণ্য করবার প্রবণতা আছে। ক্যাপ্টেন কতটা দক্ষ তা যাচাই করবার একমাত্র উপায় হলো পাঁচ দিনের টেস্ট। টি-২০-তে একজন ক্যাপ্টেনের গুরুত্ব ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেনের মতোই প্রাসঙ্গিক, তবে অপরিহার্য নয়। ওয়ানডে ম্যাচের সময় ক্যাপ্টেনগিরির জন্য অলরাউন্ডার পাওয়া গেলে চমৎকার হয়। ওটা অবশ্য অন্য কাহিনী। অতিসুন্দর স্তরের ক্রিকেট হচ্ছে ধীরগতির খেলা যা কৌশলগত বৈচিত্র্য আর সিদ্ধান্ত প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করে। খেলা কীভাবে এগোচ্ছে তা টেস্ট ক্যাপ্টেনকে অবিরাম বিশ্লেষণ করতে হয়। এমনকি চার ওভার পরপর তাকে ফিল্ডিংয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়। তার টিম যখন ব্যাটিং করে তখন তাকে চেষ্টা করতে হয় রানের ধারা নিয়ন্ত্রণের জন্য। একেবারে শুরুর দিন থেকে যেভাবে খেলছেন তাতে বলা যায় যে, হাশিম আমলা চিন্তাশীল ক্যাপ্টেন এবং সুবিবেচক মানুষ। তিনি সব সময় নির্ভীকচিত্তে হাঁটেন। সততার জন্য যে সুখ্যাতি তা তিনি অর্জন করেছেন। তবে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কঠিন সিরিজ চলার মাঝপথে যে নির্ভয়তার সঙ্গে ক্যাপ্টেন পদটি ফেলে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন, ওই ব্যাপারটিই তাকে স্মরণীয় করে রাখবে। হাশিম আমলার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল অনুজ্জ্বল রান করছিল। পিচ নিয়ে যে বিতর্ক ফেনিয়ে তোলা হয়েছিল, তা দিয়ে কিন্তু ভারতে সম্প্রতি হয়ে যাওয়া সিরিজে আফ্রিকানদের ব্যর্থতা চাপা দেওয়া যায়নি। পিচ সহায়ক ছিল না বলে খারাপ করেছে তারা, এটা একটা কৌতূহলোদ্দীপক অজুহাত। দুই পক্ষকে তো একই পিচে খেলতে হয়। পিচ মন্দ হয়ে থাকলে তা উভয়ের জন্যই মন্দ ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকান পেসাররা সুবিধাজনক অবস্থান পেয়ে গেলে পিচ বানানোর সময় ‘চাতুরী’ করা হয়েছে বলে কেউই ইংলিশ গ্রাউন্ডসম্যানকে দোষারোপ করে না। তাহলে ইংল্যান্ডের স্পিনারদের কৃতিত্বের বেলায় ধারাভাষ্যকাররা বক্রদৃষ্টি হানেন কেন? প্রসঙ্গত বলছি, ভারতের কাছে সিরিজ হারানোর পর ভিত্তিহীন কোনো অজুহাতের আশ্রয় নেননি হাশিম আমলা। তার সমস্যাগুলো জটিল করে তুলেছিল তার নিজেরই দুঃখদায়ক স্কোর।

দক্ষিণ আফ্রিকায় চলমান সিরিজের প্রথম টেস্টে ইংল্যান্ডের বিজয় পর্যন্ত আমলার বিষণ্ন স্কোরের ধারা বজায় ছিল। দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে আমলা যখন ব্যাটিং করতে এলেন তখন তো তার দলের হার অপরিহার্য বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছিল। তিনি ডাবল সেঞ্চুরি করলেন। এতে ব্যাটসম্যান হিসেবে তার মর্যাদাই শুধু পুনঃপ্রতিষ্ঠায় পায়নি, ক্যাপ্টেন হিসেবে তার নেতৃত্বের তেজস্বিতাও ফের স্বীকৃতি পেল। নিজের দলটি ব্যাট করার সময় বক্সে বসে থাকা ক্যাপ্টেনের করণীয় কিছুই থাকে না, এটা মনে করা ঠিক নয়। ইনিংসের প্রতিটি খেলোয়াড়ের ভূমিকা তিনিই ঠিক করেছেন; কাজটা অনেকটা নীরবে কনুইয়ের ধাক্কা দিয়ে কর্তব্যসচেতন করে তোলার মতো। পারফরম্যান্স দিয়ে সন্দেহ-সংশয় যখন দূর করে দিলেন ঠিক সেই সময়টায় পদত্যাগ করলেন হাশিম আমলা। খেলোয়াড় ও নেতা হিসেবে শীর্ষে ফিরে এসেই নেমে পড়লেন তিনি। দুলকি চালে চলনের দায়ে সিলেক্টররা যদি ক্যাপ্টেনদের ছাঁটতে থাকেন তাহলে কোনো ক্যাপ্টেনই দুই কি তিন মৌসুমের বেশি টিকে থাকবেন না। এমনকি দম বন্ধ করা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ফুটবল ক্লাবের মালিকরাও ব্যর্থ ম্যানেজারদের বরখাস্ত করতে গিয়ে সময় ক্ষেপণ করেন। আমলাকে ধাক্কা দেওয়া হয়নি। স্বদেশের টিমের বৃহত্তর স্বার্থে যা যথার্থ বিবেচনা করেছেন তা-ই করেছেন। নিজেই নিজেকে বারণ করেছেন। এ রকম দৃষ্টান্ত বিরল। নাম বলছি না, তবে দেখা গেছে, ক্যাপ্টেনরা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকেন, কারণ এ ক্ষমতার ব্যবহারে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য আর্থিক সুবিধাদি ভোগ করা যায়। একদা ক্রিকেটকে বলা হতো ‘ভদ্রলোকের খেলা’। ওই অবস্থা এখনো বজায় আছে, কথাটা জোর দিয়ে বললে তা হবে গুরুতর অতিরঞ্জন। ক্রিকেটে এখন ভদ্রলোকেরা যেমন আছে, তেমনই আছে তস্কররাও। ব্যাপারটা ভালোও নয়, মন্দও নয়। ব্যাপারটা প্রজাতান্ত্রিক জমানায় মূল্যবোধের বা মূল্যবোধহীনতার অপরিহার্য পরিণতি। এ জমানায় গুরুতর টাকাকড়ি তাদের কাছেই যায় যারা বিক্রি করতে জানে পণ্য। ক্রীড়াঙ্গনে ভদ্রজনের আগমন ঘটায় উৎসব আনন্দ। নিয়তি যে কোনো ব্যক্তিকেই ভূমিকা গ্রহণের জন্য বলতে পারে, ওই ভূমিকা নিয়ে সে আদর্শ হয়ে উঠবে কিনা, তা কিন্তু নির্ভর করে ব্যক্তিবিশেষের ওপর।

 

বিডি-প্রতিদিন/ ১৩ জানুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর