২৭ জানুয়ারি, ২০১৬ ১০:১৬

কেউ ভোলে না কেউ ভোলে

নঈম নিজাম

কেউ ভোলে না কেউ ভোলে

ইন্দুবালা দেবীর কণ্ঠে একটি গান শুনেছিলাম— কেউ ভোলে না কেউ ভোলে, অতীত দিনের স্মৃতি। কবি নজরুলের এই গানটিতে ইন্দুবালা কণ্ঠ দিয়েছিলেন ১৯৩২ সালে। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর কণ্ঠেও এই গান ছিল অসাধারণ। জীবনের পরতে পরতে দুঃখ-কষ্টকে লালন করে আমরা চলি। মানুষকে বোঝা যায় না। সময় অনেক কিছু বদলে দেয়। জীবনের জলছবিতে আমরা ভুলে যাই। পেছনে ফেলে আসা সময়গুলো ধূসর হয়ে যায়।  স্বপ্নচূড়ায় জেগে ওঠে বর্তমান। ইতিহাসের অনেক কিছু আমরা ভুলে যাই। ভুলে যাই বর্তমানকে। সেদিন অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী আসলেন অফিসে। কথা হলো তার সঙ্গে পুরনো কিছু ঘটনা নিয়ে। গণআদালত গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের কাজ আহাদ চৌধুরীরাই শুরু করেছিলেন। আহাদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলার সময় মনে পড়ে গেল ’৯১ সালের পুরনো স্মৃতিগুলো। আমি তখন কাজ করি আজকের কাগজে। ’৯২ সালে ভোরের কাগজে। গণআদালত শিরোনামে তখন আমার একটি বই বের হয়েছিল। আসলে বইটি ছিল একজন রিপোর্টারের ডায়েরি। কীভাবে কারা গণআদালত করেছিলেন সেসব ঘটনা।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ ধারা লঙ্ঘন করে জামায়াত পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আযমকে ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর আমির ঘোষণা করে। এ ঘোষণা শুনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি হতবাক হয়ে যায়। সংবিধানের ৩৮ ধারা লঙ্ঘনের পরও বিএনপি সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ পরিস্থিতিতে ৩০ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল (আহাদ-আজিজ)-এর এক বৈঠক অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়। আহাদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য জিল্লুর রহিম দুলাল বললেন, আমাদের ব্যর্থতার কারণে জামায়াত আজ এই দুঃসাহস দেখিয়েছে। তাই শুধু প্রতিবাদ করে হবে না, আসুন আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করি। সঙ্গে সঙ্গে আহাদ চৌধুরী বললেন, আজই আমাদের কর্মসূচি নিতে হবে। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে ৩১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল গোলাম আযমের ফাঁসি দাবি করে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলে গোলাম আযমের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।

একই সময় কর্নেল (অব.) কাজী নূরুজ্জামান যোগাযোগ করেন সাপ্তাহিক বিচিত্রার নির্বাহী সম্পাদক শাহরিয়ার কবীরের সঙ্গে। আলোচনা হয় একটা কিছু করা প্রয়োজন। ৩১ ডিসেম্বর রাতে বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর বাসভবনে একটি পার্টি ছিল। সিদ্ধান্ত হয় সেখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ একত্রিত হবে। সেখানেই আলাপ করা হবে কী করা যায়। শাহরিয়ার কবীর জানতেন আহাদ চৌধুরীর উদ্যোগের কথা। এর আগে ১৯৮১ সালে কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও নঈম জাহাঙ্গীর সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে জামায়াত ও গোলাম আযমবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তখন সাত দফা কর্মসূচি নিয়ে কাজ করে। জিল্লুর রহিম দুলাল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের (আহাদ-আজিজ) চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী ও মহিউদ্দিন আহমদ এমপিকে নিয়ে ৩১ ডিসেম্বর রাতে শাহাদত চৌধুরীর বাসভবনে যান। সেখানে অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরীর সঙ্গে লে. কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামানসহ অন্যদের আলোচনা হয়। লে. কর্নেল নূরুজ্জামান বললেন, আহাদ সাহেব আসুন একটা কিছু করি। আহাদ চৌধুরী বললেন, আমরা শুরু করে দিয়েছি। ঐক্যবদ্ধ হলে সবাই একসঙ্গেই কাজ করব। ঠিক এ সময়ে লে. কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান কবি সুফিয়া কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সুফিয়া কামাল বললেন, আমি এই আন্দোলনের সঙ্গে থাকব। কিন্তু বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমার পক্ষে কাজ করা কঠিন হবে। সুফিয়া কামাল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নাম প্রস্তাব করেন। জাহানারা ইমাম চিকিত্সার জন্য তখন আমেরিকায় অবস্থান করছিলেন। তিনি দেশে ফিরে আসেন ৬ জানুয়ারি। জাহানারা ইমাম অবশ্য ১৯৮১ সাল থেকে গোলাম আযমের বিচারের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।

ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার লক্ষ্যে ৯ জানুয়ারি আজিজ সুপার মার্কেটে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বানে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী, মহাসচিব আবদুল আজিজ, আবদুল্লাহ সরকার, জাসদের কাজী আরেফ আহমদ, আওয়ামী লীগের সাজেদা চৌধুরী, সিপিবির নুরুল ইসলাম নাহিদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, লে. কর্নেল (অব.) মনিরুল ইসলাম চৌধুরী, ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্য সংস্থার মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুর রহিম দুলাল, ছাত্রনেতা শফি আহমদ, রুহিন হোসেন প্রিন্স, অসীম কুমার উকিল, জায়েদ ইকবাল, আবু আসলাম মিন্টু, নাঈম উদ্দিন, মোশরেফা মিশু অংশ নেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তখন দেশের বাইরে। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুস সামাদ আজাদ ও সাধারণ সম্পাদিকা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনার পর আবদুর রাজ্জাককে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ মঞ্চে দেওয়া হয়। যুক্ত হন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। অন্যান্য দলের নেতারাও এভাবে সম্পৃক্ত হন। তবে কাজী আরেফ শুরু থেকে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৪ জানুয়ারি আহাদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আবদুর রাজ্জাক, আবদুল আজিজ, কাজী আরেফ আহমদ, নুরুল ইসলাম নাহিদ, ন্যাপ নেতা পীর হাবিবুর রহমান, মীর্জা সুলতান রাজা, হাফেজ মোহাম্মদ দানিয়েল, আবদুল হালিম, সি আর দত্ত, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল, অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী, ড. হারুনর রশীদ, আবদুস কুদ্দুস মাখন, ব্যারিস্টার শওকত আলী, লে. কর্নেল (অব.) মনিরুল ইসলাম চৌধুরী, জিল্লুর রহিম দুলাল, জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু, শাহে আলম, অসীম কুমার উকিল, নাসিরউদ্দোজা, নূর আহেমদ বকুল, শফি আহমেদ, মোশরেফা মিশু উপস্থিত ছিলেন।


বৈঠকে গণআদালত গঠনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন লে. কর্নেল (অব.) মনিরুল ইসলাম চৌধুরী। লে. কর্নেল মুনির তার বক্তৃতায় বিভিন্ন দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চিত্র সবার সামনে তুলে ধরে বলেন, যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের লক্ষ্যে ‘পিপলস ট্রায়াল কোর্ট’ গঠন করা যেতে পারে। তার বিচার হবে লাখো মানুষের সামনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

এদিকে লে. কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান ও শাহরিয়ার কবীর প্রমুখ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন। ছাত্রনেতাদের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। ১৯ জানুয়ারি নূরুজ্জামানের বাসভবনে এক বৈঠক হয়। এর আগে ৬ জানুয়ারি শহীদ রুমির মা বিশিষ্ট লেখিকা জাহানারা ইমাম আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন। সবাই তার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। ১৯ জানুয়ারি কর্নেল জামানের বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ডা. কামরুজ্জামান, নঈম জাহাঙ্গীর, কবি সুফিয়া কামাল, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. আহমদ শরীফ প্রমুখ। সভায় যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের লক্ষ্যে ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ বৈঠকে ছাত্রনেতারাও উপস্থিত ছিলেন। ড. আনিসুজ্জামান ও শাহরিয়ার কবীর ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করেন। ২১ জানুয়ারি খসড়া চূড়ান্ত হয়। সর্বজনশ্রদ্ধেয়া জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নাম ঘোষণা করা হয়। ১৯ জানুয়ারি বৈঠকে উপস্থিত না থাকলেও কবি শামসুর রাহমান, শওকত ওসমান, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ, বিচারপতি কে এম সোবহান, কবীর চৌধুরী এই আন্দোলনের সঙ্গে তাদের একাত্মতার কথা ঘোষণা করেন।  জাহানারা ইমাম শুরু থেকে ব্যাপক উত্সাহ-উদ্দীপনা নিয়ে কাজ শুরু করেন। তার এই উত্সাহ-উদ্দীপনা সবাইকে উজ্জীবিত করে তোলে। নির্মূল কমিটি ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ (আহাদ-আজিজ) একই লক্ষ্যকে সামনে রেখে আলাদাভাবে কাজ শুরু করেন।

২৪ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ গঠিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটি নামে পরিচিতি লাভ করে। এর দায়িত্বে ছিলেন আহাদ চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী, অধ্যাপক মান্নান চৌধুরী ও কর্নেল মনিরুল ইসলাম চৌধুরী। আবদুল মতিন চৌধুরীকে সদস্যসচিব করা হয়। প্রতিরোধ মঞ্চ ও নির্মূল কমিটি আলাদাভাবে কাজ শুরু করে। মহানগর সমন্বয়ের দায়িত্বে কাজ করতে থাকেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, আমিনুল হক মন্টু, সাদেক আহমদ, আবুল হাশেম প্রমুখ। এর মধ্যে কয়েকজন ছাত্রনেতা দুটি কমিটিকে একত্রীকরণের উদ্যোগ নেন। আলোচনা শুরু হয় অধ্যক্ষ আহাদ চৌধুরী ও লে. কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামানের সঙ্গে। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার লক্ষ্যে দুই কমিটির নেতারা ৮ ফেব্রুয়ারি আলোচনা শুরু করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি কর্নেল (অব.) তাহের মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত দুই কমিটির বৈঠকে জাহানারা ইমাম এক আবেগময় বক্তব্য রাখেন। তিনি সবার সামনে বলেন, আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আমার সব হারিয়েছি স্বাধীনতা যুদ্ধে। স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। জাহানারা ইমামের এই বক্তব্যের পর দুটি কমিটি ঐক্য গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। ঐক্যবদ্ধ কমিটির নামের খসড়া তৈরি করতে গিয়ে অধ্যাপক মান্নান চৌধুরী লেখেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’। পরে তা সংশোধন করে ঘাতকের আগে একাত্তরের শব্দটি লেখা হয়। ২৬ মার্চ গণআদালতকে সফল করার লক্ষ্যে সবাই কাজ শুরু করেন। আওয়ামী লীগ এবং পাঁচ দলের সঙ্গে নির্মূল কমিটি ও সমন্বয় কমিটির কয়েক দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় রাজনীতিবিদদের মধ্যে আবদুর রাজ্জাক এমপি, নুরুল ইসলাম নাহিদ, কাজী আরেফ, নির্মল সেন, রাশেদ খান মেনন আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন।

২০ মার্চ নির্মূল কমিটির নেতারা শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। তারা শেখ হাসিনার সহযোগিতা চাইলে তিনি বলেন, স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও চেতনা পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে আমি আমার জীবন বিলিয়ে দেব। শেখ হাসিনার বক্তব্য সবার উত্সাহ বৃদ্ধি করে। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতিরা হুমকি দিল তারা গণআদালত ভেঙে দেবে। ১৮ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরী, স্বরাষ্ট্র সচিব লুিফল্লা হিল মজিদসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে নির্মূল কমিটির নেতাদের বৈঠক হয়। বৈঠকে জাহানারা ইমাম, আবদুর রাজ্জাক, অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী, কাজী আরেফ আহমদ, সৈয়দ হাসান ইমাম, লে. কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান, অসীম কুমার উকিল, শফি আহমদ, নুর আহমেদ বকুল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এই আলোচনা সফল হয়নি। কারণ সরকার কর্মসূচির বিপক্ষে ছিল। তবে নাগরিকত্ব নিয়ে ২৩ মার্চ সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে প্রথমবারের মতো সরকার গোলাম আযমের কাছে কারণ দর্শাও নোটিস পাঠায়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ২৪ মার্চ রাতে গোলাম আযমকে গ্রেফতার করা হয়। একই সময় গণআদালত গঠন করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অভিযোগ এনে জাহানারা ইমামকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নোটিস পাঠায়। ইতিমধ্যে গণআদালতের পক্ষে দেশব্যাপী জোয়ার সৃষ্টি হয়। সরকার কিছুটা ভীত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়। গণআদালত নস্যাৎ করতে সরকার বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেয়। ঢাকা শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে গণআদালত হচ্ছে না। তীব্র হতাশার মধ্যে জ্বলে ওঠে আশার আলো। এই আলোর প্রদীপ নিয়ে আসেন শেখ হাসিনা। ২৫ মার্চ রাতে সমন্বয় কমিটির নেতারা ২৯ মিন্টো রোডে বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার বাসভবনে আসেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে সমন্বয় কমিটির এক নেতা সমঝোতাপূর্ণ অবস্থান সৃষ্টি করে গণআদালতকে গণসমাবেশ করার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। আহাদ চৌধুরী এর বিরোধিতা করলে শেখ হাসিনা জাহানারা ইমামকে বললেন, খালাম্মা আপনি কি চান? জাহানারা ইমাম বললেন, যে কোনোভাবে আমি গণআদালত করার পক্ষে। এরপর শেখ হাসিনা বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না, আওয়ামী লীগের ২ লাখ কর্মী গণআদালতের সময় থাকবে। সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া লাখ লাখ সাধারণ মানুষ থাকবেই। আপনি আপনার উদ্যোগ সফল করুন। বাংলার মাটিতে রাজাকারের ঠাঁই হবে না। শেখ হাসিনার এই ঘোষণাতেই সফল হয় গণআদালত।

২৬ মার্চ সকাল থেকে লাখো মানুষের ঢল নামে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। একজন সাংবাদিক হিসেবে জনতার এমন বিশাল ঢল আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। পুলিশি বাধা অতিক্রম করে সবাই জড়ো হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে একটি ট্রাকে দাঁড়িয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির নেতা আবদুর রাজ্জাক এমপি জনতার সামনে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, যে স্থানে দাঁড়িয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন একই স্থানে আজ আমরা ঘাতক দালালদের বিচারের জন্য সমবেত হয়েছি। একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার আমরা করবই। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা ছিলেন গণআদালতের প্রত্যক্ষদর্শী। জাহানারা ইমামকে গণআদালতের বিচারকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান করা হয়। মোট ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক ও ব্যক্তিত্ব গণআদালতের উদ্যোক্তা হন। বিচারকমণ্ডলীর সদস্যরা ছিলেন অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, ড. আহমদ শরীফ, স্থপতি মাযহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমদ, ফয়েজ আহমদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, মাওলানা আবদুল আউয়াল, লে. কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান, লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী ও ব্যারিস্টার শওকত আলী। গণআদালতের অভিযোগকারী হচ্ছেন বাংলাদেশের গণমানুষ। আর গণমানুষের পক্ষে তা উত্থাপন করেন ড. আনিসুজ্জামান, ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ শামসুল হক। অভিযোগের পক্ষে কৌঁসুলি ছিলেন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, অ্যাডভোকেট শামসুদ্দিন বাবুল, অ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম রেখা। গণআদালতে গোলাম আযমকে আইনজীবী পাঠানোর আহ্বান জানানো হয় কিন্তু আসামির পক্ষ থেকে কোনো আইনজীবী না আসায় ন্যায়বিচারের জন্য অভিযুক্ত গোলাম আযমের পক্ষে অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলামকে (আসিফ নজরুল) গণআদালত কৌঁসুলি নিয়োগ করেন। গোলাম আযমের পক্ষে নিযুক্ত কৌঁসুলিকে অভিযোগসমূহ পাঠ করে শোনালে অভিযুক্ত গোলাম আযমের পক্ষে নিযুক্ত কৌঁসুলি তার মক্কেলকে নির্দোষ দাবি করেন।

গণআদালতে মোট ১৫ জন সাক্ষ্য প্রদান করেন। এরা হলেন— ড. আনিসুজ্জামান, ড. বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, সৈয়দ শামসুল হক, শাহরিয়ার কবীর, মুশতারি শফি, শহীদ প্রকৌশলী ফজলুর রহমানের ছেলে সাইদুর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সারের ছেলে অমিতাভ কায়সার, হামিদা বানু, মাওলানা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী, আলী যাকের, ডা. মোশতাক হোসেন ও ১৯৭১ সালের তিনজন বীরাঙ্গনা নারী। সফলভাবে গণআদালত অনুষ্ঠিত হয়। গণআদালতের সংবাদ পরিবেশনের জন্য ২৭ মার্চ দেশের সব সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার দিনটি সংবাদপত্রের ছুটির দিন ছিল।  দেশি-বিদেশি পত্র-পত্রিকায় গণআদালতের সংবাদ পরিবেশিত হয়। বিচারকাজ শেষে কিছু সাংবাদিক মিছিল করে জাতীয় প্রেসক্লাবে আসেন।

 
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

বিডি-প্রতিদিন/ ২৭ জানুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর