৩১ জানুয়ারি, ২০১৬ ১৪:১৪

প্রার্থনার স্বাদ

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

প্রার্থনার স্বাদ
টিভি চ্যানেলে অধমের ইন্টারভিউ। ২৫ মিনিটের। ড্রেস, মেকআপ, বক্তব্য, ক্যামেরার প্রক্ষেপণ, কাঁটায় কাঁটায় সময়ানুবর্তিতা। প্রস্তুতির শেষ নেই, বহু লোক দেখছে বলে কথা। ‘এলার্ট’ প্রতি মুহূর্তে। ক্যামেরার সামনে এবার আপনি। ‘আল্লাহু আকবর’ বলে হাত উঠানোর সঙ্গে বাটনটি লাল, ‘ক্যামেরা অন’। রাজাধিরাজ সামনে। অভীষ্ট, বিচারক, যার হাতে কর্মফল। তারই নিয়মে সৌরমণ্ডল। বড় ছোট কোনো কিছুই নয় তার দৃষ্টির অগোচর। দূরদূরন্ত কম্পিত বক্ষ। হূদয় যন্ত্র উঠছে নামছে। অজু ঠিকমতো ছিল কি, পরিচ্ছদ ছিল কি পরিষ্কার, সুরা পাঠ ওলট-পালট হয়নি তো? যখন রুকু ও সিজদায়, জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে গেছে। ময়লা কাপড় থেকে সাবান যেমন ময়লা বের করে নিয়ে আসে, তেমনি রুকু সিজদা জীবনের সব গুনাহ সাফ করে দিল। যখন কোনো নামাজিকে দেখি অনেকক্ষণ রুকুতে, সিজদায়, জানি তিনি কি পেলেন। একবার পেয়ারা নবী [সা.]-কে সিজদায় যাওয়ার পর অনেকক্ষণ না উঠতে দেখে সাহাবিরা হলেন শঙ্কিত। তবে কি নেই? উনি বহুক্ষণ প্রভুর সান্নিধ্যে। ‘আল্লাহু আকবর’ বলার পর কি পরিবর্তন? কিছুক্ষণ আগে যা অনুমোদিত, তা এখন বাতিল। খাওয়া-দাওয়া, পানীয়, কথাবার্তা, অনাবশ্যকীয় নড়াচড়া, সব বাতিল। কি এমন হলো যাতে যাবতীয় কার্যক্রম সম্পূর্ণ রহিত? বোঝার চেষ্টা করি কার্যকলাপ প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা। ভৃত্য দাঁড়াবে ভৃত্যের ভঙ্গিতে, অতিশয় বিনয়ী হয়ে যা কিছু জিজ্ঞাসা তার উত্তর দেওয়ার মতো, বসনে ভুষনে দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে পূর্ণ বশ্যতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কি? এখন আপনি উচ্চতর বিহারে। নিজকে পরিপূর্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করার মানসে স্থির প্রতিজ্ঞ। এখনো কি আপনার মানুষতরঙ্গ এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করছে? করে থাকলে, সব মাটি, উচ্চারণ তাই কয়েক বার ‘আল্লাহু আকবর’ মনে করাতে যে আপনাকে দিয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছে। সমস্যার সমাধান? আছে, যদি জানা থাকে। প্রভুর পবিত্র নাম সমুদয় বরকতের একমাত্র উৎস, সব ধরনের ক্ষতি থেকে রক্ষার কবচ। তাই ক্ষতির উৎস থেকে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করি। শয়তান বিপথে নেওয়ার জন্য উদ্গ্রীব। উচ্চারণ করি : ‘আউযুবিল্লাহি মিনাস শায়তান আররাজিম’ [বিতাড়িত শয়তানের কাছ থেকে পরিত্রাণের জন্য আল্লাহর সাহায্য চাই]। এবার আল্লাহর শক্তি আপনার মধ্যে প্রবেশ করেছে। এবার ভাবুন একটি পাওয়ার পয়েন্টের কথা, যাতে শুধু আপনি। আপনার দেহে যা তা নিয়ে ভাবুন [যেমন রক্তকণিকা প্রবাহ, রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাপনা, স্নায়ুতন্ত্র, হরমোন সিস্টেম, যকৃতের কোষ, প্লীহা, মূত্রাশয় ইত্যাদি।] ভাবুন, চারপাশের কথা, সবুজ প্রকৃতি, পশুপাখির রাজত্ব, সাতসমুদ্র, পোকামাকড়ের রাজত্ব এবং জীবাণুর পৃথিবী। গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থানের মধ্যে সূর্য, সৌর জগত্, এখান থেকে কোটি কোটি মাইল দূরে অগণিত সূর্য তারকা। অগোচর যে সৌরজগত্, যা কোনো দিন দেখতে পাব না, তার কথা ভাবুন। ফেরেশতাদের কথা শুনে এসেছি, তারা কেমন দেখতে। জিনরা কেমন, পরীরা কেমন। আপনি ক্লান্ত। বার বার ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসছেন নিজের কাছেই যেখান থেকে দাঁড়িয়ে এবাদত করছি। বিশাল ক্যানভাসে কোথায় আমার অস্তিত্ব? একটি নুড়িও তো নই। কোথায় লুটাল আমার এত অহংকার? এত জ্ঞান ভাণ্ডার কোনো কাজেই এলো না। তার বিরাটত্বের কাছে কিছুই নই। ‘হাসন রাজায় কয়, কিছু নয় রে, আমি কিছু নয়/ অন্তরে বাহিরে দেখি কেবল দয়াময়।’ সৃষ্টি জগতের মাত্র একটি আমি জানি। আরও ছটি, যা কোরআনে বর্ণিত, তাও এর বাইরে। সব কিছুর মধ্যে মহান সিংহাসনের আসনে আসীন যিনি, তার পরিচালনায় সবকিছু সঠিক মতো চলছে। যখন তার প্রশংসা করেন তখন আপনার কেমন লাগে? প্রতিটি কথার পর যখন তার জবাব আসে, কেমন লাগে? এখনো কি তার কথার প্রতিবাদে উত্সাহী? কোনো কোনো কথার বিরুদ্ধে কি এখনো কোমর বেঁধে লড়তে চান? সেই মহান উত্কৃষ্টের চাবি যার হাতে, তার রাজ্যে আর একটিও অন্যায় করতে কি আপনার মন চায় যার সার্বভৌমত্ব অনস্বীকার্য? তার যা প্রাপ্য, সেখান থেকে পরিপূর্ণভাবে না দেওয়া কি আমাদের সাজে? তার বিপুল শানের পরিবর্তে কি সাজে অমনোযোগী মোনাজাতের? তার তো একটিই চাওয়া। কেন এত অমনোযোগ? মহানবী (স.) বলছেন তাকে তো দেখতে পাবে না, আমিও না। তবে তার কুরসি [রাজ সিংহাসন] পরিব্যাপ্ত আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত [২:২৫৫] এবং আল্লাহ সপ্ত আকাশ একটি ছোট্ট আংটির সমান, যা পড়ে আছে বিরাট মরুভূমির মাঝারে। এরপরে যখন নামাজে দাঁড়িয়ে আলোকপাত করবেন একটি শব্দের উপরে তা হলো ‘রাব্বিল আলামিন’। তখন ভাববেন তিনি কত বড়। ‘আল ফাতিহা’র মধ্যে লুকান অনেক। ধরা যাক, একটি খুন হয়েছে। খুনের তদন্ত চলাকালে উপস্থিত আপনি। কোনো দোষ না হলেও বিচার কার্যে জড়ানো হচ্ছে আপনাকে। প্রশ্নের পর প্রশ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছেন। যেমন : খুনের সময় এখানে ছিলেন, কী করছিলেন, কটার সময় এলেন, কী দেখলেন ইত্যাদি? যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, বিচারকের সেই সময়ে খানিকটা নরম সুর : যদিও জানি আপনি নিরপরাধ, তদন্তের স্বার্থে অনেক তথ্য আমাদের জানার প্রয়োজন। অথবা প্রথমেই বলা হবে, আপনার কাছে যা জানা আছে তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করুন। এখন আপনি খানিকটা সুস্থ বোধ করছেন। কখনো ভেবে দেখেছেন, ‘আর রাহমানির রাহিম’-এর আগে ‘মালিকি ইয়াউমি দ্দিন’ কেন এল? এটা মনে করাতে যে ‘আর রাহমানির রাহিম’ বিচার দিনের বিচারক। এই দুটো নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হওয়ায় আমরা আমাদের নামাজের মধ্যে খানিকটা স্বস্তি পেলাম। ‘আর রাহমানির রাহিম’ বলছে যে, আল্লাহর সার্বভৌমত্বের সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তার সর্বদা প্রবাহমান দয়া [শাস্তিরূপ নয়]। সবার জন্য এ দয়া। বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, ভালো পথের পথিক অথবা অন্যায় পথের। খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ কোনো কিছুই এর প্রভাবিত নয়। শাস্তির খড়গ ঝোলান নেই কারও জন্যই। বিচার শেষ দিনে। জীবন ভরেও অন্যায় করে যেতে পারবে। অনেক সময় আল্লাহর দয়া বলতে শুধু তার দান নয়, বরং তার দান স্থগিত হলে, সেটাও দয়া। দানে বিরত হওয়ার সময়টি বরদাস্ত করি না, জ্ঞানের অভাব। পড়ুন : ‘উনি কি তাদের জানেন না, যাদেরকে তিনি সৃষ্টি করেছেন’ [৬৭:১৪]? ‘এমনও হতে পারে তোমরা এমন কিছু অপছন্দ কর যা তোমাদের জন্য ভালো, আবার এমনও হতে পারে যে তোমরা একটি জিনিস ভালোবাস, যা তোমাদের জন্য মন্দ। এটি একমাত্র স্রষ্টা জানেন, অথচ তোমরা জান না’ [২:২১৬]। যখন বলি, ‘আর রাহমান’, দয়া বলতে যা বোঝায়, সবই এর সঙ্গে যুক্ত করি। বলি : ‘জাহ্নবি যমুনা, রাহমান রাহিমা’। আরবিতে রাহমান বলতে দয়ার সাগর বোঝায় অর্থাত্ এখানে আর কোনো খাদ নেই। যখন প্রার্থনায় ‘মালিকি ইয়াউমি দ্দিন’ বলি, তখন একটু ভাবি। মুমিনের অবস্থান পূর্ণ আশা ও ভীতির মাঝখানে। প্রার্থনার স্বাদ তখনই গ্রহণ করা যাবে যখন মনের অবস্থাটি হবে প্রার্থনার অনুকূল। যখন নদীতীরে যাই তার স্নিগ্ধ মলয় সমীরণ মনকে প্রফুল্ল করে। পাহাড়ে যাই, দেখি পাখিদের অবাধ বিরচণ। ওরা কত সুখি। ওরা কত অল্প চায়, ওরা কি সুন্দর গান গায়। আমি কেন অল্প চাই না, আমি কেন গান পারি না। তখন মন চায় পাখি হতে। পাখিদের দেওয়া হয়েছে পাখা। আমাদের দেওয়া হয়েছে মন, সেই মন নিয়ে আমরা পাখিদের চেয়েও অনেক বেশি দূরে যেতে পারি। প্রার্থনা সেই মনেরই চর্চা। 
 
লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব। ই-মেইল :[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর