আমরা খুব সৌভাগ্যবান যে, আমাদের জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারির মতো এমন একটি অবিনস্বর চেতনার মালিক হতে পেরেছি। সৌভাগ্যবান অনেক অর্থেই, তবে আমি বিশেষভাবে মনে করি, এই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যার জন্যে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগেই আমাদের তরুণরা রক্ত দিয়েছেন। অর্থাৎ বাংলা ভাষার এবং সাহিত্যের একটা সংগত মালিকানা আমরা অর্জন করতে পেরেছি। ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা দরকার। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আমাদের এত যে আন্দোলন, তা তো নিছক আবেগের উত্তাপ নয়। মায়ের ভাষা প্রাণের ভাষা, এগুলো আমাদের চিরাচরিত সম্পদ। কিন্তু তার সঙ্গে কখনো বা আড়ালে পড়ে যায় একটা বাস্তব উত্তরাধিকারের প্রশ্ন।
আমি বলতে চাচ্ছি, রাজনৈতিক কারণে (অনেকটা সাম্প্রদায়িক কারণেও) ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় দুটো ভিন্ন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। সেটি যদিও অন্য কথা, কিন্তু বাস্তব অভিঘাতের দিকটা হলো, বাংলা ভাগ হওয়ার ব্যাপারটা। এর পরিণামে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য অবাঞ্ছিতভাবে দুটো ভিন্ন বলয় দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। অর্থাৎ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটা বড় অংশ তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে আবদ্ধ হয়ে যায়। পরিণামে, বৃহত্তর পাকিস্তানের শাসনে ও শোষণে একটা বিকলঙ্গ দশায় পড়ে যাই আমরা। সেই থেকে আমাদের ভাষা এবং সাহিত্য একটা বিকৃত পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। অবশ্য এতদিন পরে বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে আমাদের মাতৃভাষা ও সাহিত্যের চর্চা মৃত্তিকা সংলগ্ন হয়ে উঠেছে। এখন সময়ের পরিণামে এগিয়ে যাওয়ার সাধনা। কিন্তু একটা গুরুতর বিষয় রয়ে গেছে। অর্থাৎ মূলত বাংলা ভাষা ও সাহিত্য স্বাধীন ও অখণ্ড পরিণতি কতটা পেতে যাচ্ছে, সেটাই এখন চিন্তার বিষয়। কারণ সেই ইংরেজ আমল থেকেই পূর্ববঙ্গের তথা গোটা বাংলার সাহিত্যচর্চার মুসলিম ভাষাভাষী জনগণ পিছিয়ে ছিল। এর পেছনে অনেক যুক্তিসঙ্গত কারণ তো ছিল। নানা রকম যুক্তিসঙ্গত প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম ধর্মীয় জনগণ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় অনগ্রসর ছিল। এমনকি বঞ্চিত ছিল। পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির সুবাদে এই ক্ষতিটা পূরণ হতে শুরু করে। কিন্তু আজ এবং এখনো পশ্চিমবঙ্গে বাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখকদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন, সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ, কবি শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে আজকের আকতারুজ্জামান ইলিয়াস অনেকাংশ উল্লেখের বাইরে। এটা একটা বড় ক্ষতির দিক।
আমি প্রচণ্ডভাবে আশা করি, নতুন উত্তরসূরিরা মুক্তমনে এই ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করবে এবং সামগ্রিক মূল্যায়নের নিরিখে বাংলা সাহিত্যের চর্চা এগিয়ে নিয়ে যাবে।লেখক : কবি ও শিক্ষাবিদ
বিডি-প্রতিদিন/ ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা