২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ১১:৫৯
ধর্ম চিন্তা

প্রার্থনার স্বাদ

মুস্তাফা জামান আব্বাসী


প্রার্থনার স্বাদ

সালাতে দাঁড়ালে মনটা কেমন কল্পনা করুন, পৃথিবী সেখানে অবলুপ্ত। যেখানে জায়নামাজে সপ্ত আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে আপনি। সালাতটি হতে হবে সবচেয়ে সুন্দর। বান্দাদের মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা। কোনটা ভালো, অজু, মনোনিবেশ, বেশ-ভূষা, আনুগত্য, ‘রুকু’ [নুয়ে পড়া], সিজদায়? সারা দিনে যাদের সঙ্গে আজ সাক্ষাৎ হবে তাদের সম্ভাব্য তালিকায় : চেয়ারম্যান, সেক্রেটারি, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, বড় দেওয়ানি, ছোট দেওয়ানি, আরও অনেকে।

তাদের প্রয়োজন। অথচ সবচেয়ে প্রয়োজন যাকে, তাঁর সামনে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি সর্বনিম্ন। পাশে যিনি সালাত আদায় করছেন যেন ঈদের নামাজে এসেছেন, প্রতি আচরণে যেন তার রাজাধিরাজের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তুতি। তার কাছে এই প্রণতিই শেষ প্রণতি। তিনি এগিয়ে। আপনিও আপনার সালাত করতে পারেন মধুর চেয়ে মধুর, কারণ, আপনিও প্রভুর সুন্দরতম সৃষ্টির বাইরে নন। পায়ের পাতাগুলো অত্যন্ত সুন্দর ও সুস্থভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, পায়ের আঙ্গুল একটার থেকে আলাদা। ‘রুকু’র সময় পেছন সমতায় থাকবে মাথার সঙ্গে। অনুশীলন প্রয়োজন ছোটবেলা থেকেই। স্থির থাকতে হবে সম্পূর্ণভাবে। পায়ের গ্রন্থিগুলোর দিকে তাকান, যা সুস্থিরভাবে একটার থেকে আলাদা শান্তভাবে সন্নিবিষ্ট হবে। যখন আওড়াবেন তিনবার, ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম’ [আমার প্রভু কত নিখুঁত], বিশেষভাবে ভাবতে হবে ‘রাব্বি’র অর্থ। সর্বনামটির অর্থ ‘আমার’। আমার প্রভু আমারই, আর কারও নয়, যদিও একই জায়নামাজে প্রার্থনায় বসেছি আমরা। প্রভু আমার ‘রুকু’ বেশি পছন্দ করছেন, ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম’ কথাটির মর্ম উপলব্ধি করেছি এবং সেই অনুযায়ী প্রভুর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করেছি। কীভাবে? প্রতি মুহূর্তে মনোযোগী হয়ে। প্রার্থনা অর্থ পরিপূর্ণ মনোযোগ। পৃথিবীর আর কিছু আমাকে আকর্ষণ করতে অক্ষম হচ্ছে। প্রভুর কত সন্নিকটে। চোখে পানি, কারণ এক ‘রুকু’তেই অনেকখানি অর্জন করেছি। গুনা অবলীলাক্রমে ঝরে পড়ছে অতলগহ্বরে ‘সুবহানা’ বলার সঙ্গে সঙ্গে। এটি আমরা তিনবার বলে থাকি তোতা পাখির মতো। কিন্তু তা তো নয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বার ‘সুবহানা’ বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দরবারে এটি পৌঁছে গেছে। তারপর বলি, ‘রাব্বিয়াল আজিম’। আমাদের অধিকাংশই বলার সময় কোনোরকম আবেগ অনুভূতির স্পর্শ অনুভব করি না। ‘রুকু’ যে কত বড় আনুগত্যের স্বীকৃতি তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। সমস্ত পৃথিবী তাঁর কাছে অনুগত হয়ে ‘রুকু’তে দাঁড়িয়ে, আর আমরা মাত্র কয়েকবার। আরবরা প্রথম দিকে ছিল অত্যন্ত অহংকারী। তারা এ আনুগত্যের ব্যাপারটি বুঝতে পারত না এবং ‘রুকু’তে যাওয়ার পরিবর্তে একেবারে সিজদায় পৌঁছে যেত। একবার একজন নতুন মুসলমান রসুলুল্লাহর (সা.) কাছে আবদার জানালেন যেন তাকে ‘রুকু’ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাকে অনুমতি দেওয়া হলো না। কারণ এটি আনুগত্যের প্রথম শপথ। আল্লাহর কাছে নত হতে হলে প্রথমে নত করবে তোমার হূদয়। তারপর ‘রুকু’তে ও ‘সিজদা’য়। আর কোনো ধর্মে ‘রুকু’ ও ‘সিজদা’ নেই, যেমনটি ইসলামে। এ পৃথিবীতে আমরা সবাই আলাদা। সবাই ভালোবাসা চায়, কিন্তু তার ধর্ম আলাদা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমরা আদর করে দিই, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলি। এটি না বললে যেন দিনটির মর্যাদা ক্ষুণ্ন হলো। প্রার্থনার প্রয়োজন কতখানি তা বোঝাতে হলে যেতে হয় ইতিহাসের প্রথম দিন থেকে। মানুষ কাকে ইবাদত করেনি? চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা, মূর্তি, পাথর, পানি, জীবজন্তু, সাপ, টাকাপয়সা, বিজ্ঞান, এমনকি নিজের কামনা-বাসনাকেও। ইবাদত মজবুত করার জন্য সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে। ‘রুকু’তে এসে মানুষ পেয়েছে এমন কিছুর সন্ধান যা ছিল অভূতপূর্ব। এ পৃথিবীর জীবন বড় বেশি সংঘাতপূর্ণ ও বেদনাবিধুর। কোথাও শান্তি নেই এতটুকু। একদিন হাসি, তার পরের দিনই কান্না। তাহলে শান্তি পাব যে প্রার্থনায়, সেটি কী? সেটি ‘রুকু’। ‘রুকু’তে অনেকক্ষণ অবনত হয়ে থাকলেও এতটুকু ক্লান্তিবোধ আসে না। উনি দেখছেন আমি ‘রুকু’তে, তাই ‘রুকু’র এতখানি মর্যাদা। ‘রুকু’তে যে যতখানি যত্নবান, তার মর্যাদা সেই পরিমাণে বাড়ছে আল্লাহর কাছে। যারা চট করে ‘রুকু’ সমাধা করেন, তারা কতই না ভাগ্যহীন। প্রতিদিন আমরা সতেরবার ‘রুকু’তে। ভেবে দেখুন, প্রতিদিন আল্লাহ সতেরবার বান্দার দিকে আদরের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। রসুল (সা.) বলছেন, আল্লাহ তাঁর প্রার্থনার দিকে তাকাবেন যে ‘রুকু’তে তার পেছন দিকটা সোজা করেনি। সোজা করার জন্য এত তাগিদ কেন? এ জন্য এটাই প্রার্থনার প্রকৃত রূপ। যখন কোনো প্রার্থনা করতে যাব, তার আগে এমন কিছু প্রস্তুত আছে, যা না করলেই নয়। যেমন ‘সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদা’। যখন বলি, ‘রব্বানা ওয়ালাকা আল হাম্দ’ অথবা আরও বলি : ‘হামদান কাসিরান তাইয়িবান মোবারাকান ফি’। এবার আমরা প্রশংসার সর্বোচ্চ স্তরের দিকে ধাবিত হই। যখন বলা হচ্ছে : ‘মিলা আসসামাওয়াতি ওয়া মিলা আল আরদ, ওয়া মিলা মা বায়না হুমা, ওয়া মিলা মাসিতা মিন শাইয়িন বাদ’ [প্রশংসায় ভরে যাচ্ছে সমস্ত বেহেশত, ভরে যাচ্ছে সমস্ত পৃথিবী এবং মাঝখানে যত কিছু আছে, দেখতে পাচ্ছি যত কিছু সৃষ্ট সবাই আল্লাহর প্রশংসায় অবগাহিত, যা মানুষের কল্পনায় ধরে না, যেমন প্রভুর সিংহাসন]। আমাদের জ্ঞান যে কত সীমিত তা আমরা বুঝতে পারি সেই মুহূর্তেই। আল্লাহর প্রশংসা কেন? এ জন্যই যে তা আমার মনকে করবে আল্লাহর প্রশংসা করার উপযোগী। সেই মুহূর্তেই আমি তাঁর কাছে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর যোগ্যতা অর্জন করি। এ অর্জনের জন্যই আমার এত প্রস্তুতি। মাত্র কয়েক মিনিট তাঁর সামনে। সারা দিনে মাত্র পাঁচবার। এ মুহূর্তটিই জীবনে সত্যিকার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করবে আমার জন্য। তাই প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ শুধু নয়, আমার সমস্ত অস্তিত্ব তাঁর দিকে নুয়ে থাকবে। শুধু আমার মাথা নয়, আমার সমস্ত শরীর, সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তাঁর প্রশংসায় সম্পূর্ণরূপে নুয়ে পড়েছে। যখন প্রার্থনা শেষ হবে তখনো আমি নুয়ে আছি। এরপর সমস্ত দিন, সমস্ত রাত, সমস্ত ক্ষণ ওই মিলনের আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। এ আনন্দের কোনো শেষ নেই। এটি বোঝাতে সমর্থ হব, যদি একবার প্রভুর তরফ থেকে আসে কোনো ইঙ্গিত। নানা সভায় এ নিয়ে জিজ্ঞাসিত হয়েছি। একটি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে লামা গ্রামে, যেখানে অনেক মানুষ উপস্থিত, যারা অন্য প্রার্থনায় অভ্যস্ত। বলেছি, আল্লাহ সবার প্রার্থনা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত। প্রস্তুত নই আমরাই। শুধু মুসলমানের প্রার্থনা নেওয়ার জন্যই আল্লাহ ব্যস্ত নন, তিনি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব, ইমেইল :  [email protected]

বিডি-প্রতিদিন/২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/মাহবুব

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর