১ মার্চ, ২০১৬ ১২:০৯

ইয়াহিয়ার ঘোষণা শোনামাত্রই বিক্ষোভে ফেটে পড়লাম

কাজী ফিরোজ রশীদ

ইয়াহিয়ার ঘোষণা শোনামাত্রই বিক্ষোভে ফেটে পড়লাম

১ মার্চ, ১৯৭১। আমি তখন ১২ হাজার ছাত্র অধ্যুষিত জগন্নাথ কলেজে ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি)। সকালে নেতা-কর্মীদের নিয়ে শাঁখারীবাজারে মিটিং করছিলাম। হঠাৎ রেডিওতে খবর, ‘প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছেন।’ ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়। ষড়যন্ত্রীরা বাঙালির অধিকার হরণ করার  উদ্দেশ্যেই অধিবেশন স্থগিত করেছে— এটা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। তাই রেডিওতে ইয়াহিয়ার ঘোষণাটি শোনামাত্রই আমরা বিক্ষোভে ফেটে পড়লাম। নেতা-কর্মীসহ জগন্নাথ কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে আমরা বিশাল মিছিল করলাম। মিছিলে যোগ দিলেন সাধারণ মানুষও। মিছিলটি নিয়ে গেলাম মতিঝিলে হোটেল পূর্বাণীর সামনে। ওই হোটেলের ভিতরে তখন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করছিলেন। আমরা ওখানে গেলে বঙ্গবন্ধু হোটেল থেকে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ মানুষ। ওখানে একটি রিকশার ওপর দাঁড়িয়ে শুরুতেই আমি পাকিস্তানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলাম। বক্তৃতা করি আর জনতা স্লোগান দেয়— ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’ ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’ ‘জ্বালো জ্বালো, আগুন জ্বালো’। আরও অনেক স্লোগান। এ সময় বঙ্গবন্ধু আমায় বললেন, ‘ধৈর্য ধরো। শান্ত হও। আমি দেখছি কী করা যায়।’ ওই সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে কমনওয়েলথ একাদশ বনাম পাকিস্তান বেসরকারি টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল। পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে জেনারেল ইয়াহিয়া অধিবেশন স্থগিত করেছেন, এই সংবাদ স্টেডিয়ামে পৌঁছামাত্র দর্শকরা ‘ভুট্টোর মাথায় লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ স্লোগান দিতে দিতে দর্শক রাস্তায় নেমে এলেন। টেস্ট ম্যাচ পণ্ড হয়ে গেল। অফিস, আদালতসহ সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্রোত ছিল মতিঝিলমুখী। জনসমুদ্র হয়ে গেল পুরো মতিঝিল এলাকা। ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখনও অনলবর্ষী বক্তৃতা করলেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় বললেন, ‘আমি ইয়াহিয়া খানকে বলছি, পরিষদের অধিবেশন ডাকুন। আমি কথা দিচ্ছি, আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সংখ্যালঘুরা যদি জাতির হয়ে ন্যায্য কথা বলেন, তা আমরা মেনে নেবো।’ বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে এ কথাও জানালেন যে, তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। অথচ তার সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে। এ অন্যায়। একে বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেওয়া হবে না। মতিঝিল থেকে মিছিল নিয়ে ফিরে গেলাম জগন্নাথ কলেজে। রাতে বের করলাম মশাল মিছিল। শুধু জগন্নাথ কলেজ বা আশপাশের এলাকায় নয়, ঢাকাসহ সারা দেশে সেদিন রাতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল বাঙালি জনতা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সেদিন থেকেই সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েন। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা নামিয়ে ফেলতে শুরু করে জনতা। এভাবে চলতে থাকল দুই দিন। ৩ মার্চ পল্টনে আমরা উড়ালাম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এই পতাকার জমিন ছিল সবুজ, মাঝখানে লাল রঙের সূর্য, সূর্যের ওপর ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। ছাত্রলীগ ও ডাকসুর চার নেতা এবং লাখ লাখ মানুষ সেই পতাকা দেখে হর্ষধ্বনি করে উঠল। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেওয়া হলো। সশস্ত্র কায়দায় বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার যারা দিয়েছিলেন তখনকার স্বনামধন্য ছাত্র নেতা খসরু, মন্টু, ফিরু ও মহিউদ্দীনরা।  মূলত সেদিন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন বাংলার পতাকা উঠানো শুরু হলো। পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ফেলা হলো। ৪ মার্চ আমরা হাইকোর্ট (বর্তমান সুপ্রিমকোর্ট) ভবন থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ফেলে উড়িয়ে দিলাম বাংলাদেশের পতাকা। সেদিনের আবেগ-অনুভূতি মুখে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জয়নুল হক শিকদারের একটি টয়োটা গাড়ি ছিল। ওই গাড়িতে চড়ে আমরা সেদিন হাইকোর্টে যাই। জয়নুল হক শিকদার এখন শিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অসামান্য অবদান রয়েছে। তিনি নানাভাবে আমাদের আর্থিক সহায়তাও দিয়েছেন। বিপদে-আপদে আমরা ছুটে যেতাম তার কাছে। পতাকা উত্তোলনের সময় সঙ্গে ছিলেন জয়নুল হক শিকদারের ভাতিজা আমার বন্ধু এম এ রেজা, কে এম সাইফুদ্দিন আহমেদ ও রেজা শাহজাহান। সারা দেশে খবর ছড়িয়ে পড়ল হাইকোর্টে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে। এরপর শুরু হয় অস্ত্র সংগ্রহ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ দেওয়ার সময় ওই বিশাল জনসভায় আমি ভলেন্টিয়ারের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের পরেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। ওই রাতেই জগন্নাথ কলেজে গিয়ে আমরা লড়াইয়ে নামার প্রস্তুতি নিতে শুরু করি।

লেখক : জাতীয় সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী, প্রেসিডিয়াম সদস্য : জাতীয় পার্টি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর