১১ মার্চ, ২০১৬ ১২:৪৮
দি ল্লি র চি ঠি

বিলাপ নয়, সমস্যার প্রতিকার সাধনই সরকারের কাজ

এম জে আকবর

বিলাপ নয়, সমস্যার প্রতিকার সাধনই সরকারের কাজ

মন্দ সংবাদ মোকাবিলা অর্থাৎ সমস্যার প্রতিকারের বেলায় সরকারগুলো প্রথাসিদ্ধ কাজ করার প্রবণতায় ভোগে। প্রথমত তারা আশা করে, দিন যত গড়াবে ততই উদাসীন হবে জনতা, এভাবে সমস্যাটি একদিন নিজেকে নিজেই বিলোপ করে দেবে। দ্বিতীয়ত যা করা হয় তাকে বলা চলে ‘লং বল সলিউশন’ : ‘সমস্যাটিকে পদাঘাত কর। করতে  করতে সামনে নিয়ে যাও। নিতে থাকো, নিতে থাকো, নিতেই থাকো যতক্ষণ না ওটা অন্য মন্ত্রীর সমস্যায় পরিণত হয়।’ ভারতীয় রেলপথ— যা ব্রিটিশরাজ থেকে উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া মহান একটি ব্যবস্থা— বর্তমানে যে ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় পৌঁছেছে, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে ওপরের কথাগুলোই জুতসই হবে। এ কথা খুবই সত্য যে, ব্রিটিশরা রেলপথ গড়েছিল তাদের কৌশলগত ও বাণিজ্যিক স্বার্থে। এতে করে তারা দেশময় এক অবকাঠামো আর ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করে, যা স্বাধীন ভারতের জীবনপ্রবাহ হয়ে উঠল। জনসেবার জন্য চমত্কার পরিবহন নেটওয়ার্কও দাঁড়িয়ে গেল, যা অর্থনীতির পুষ্টি জোগান দিচ্ছে আর সংযোগ করছে দৃঢ়। এতে ঐক্যের ধারণাটা সত্যিকারের অর্থবাহী হতে পারল। জনগণের ইচ্ছায় চালিত হয় গণতন্ত্র। ভারতীয় রেলপথও সেভাবে এগিয়েছে। স্বাধীন দেশে নাগরিকরা যেখানে চেয়েছে সেখানেই রেলপথ সৃষ্টি হয়েছে। পাঁচ-পাঁচটি দশক এটাই দেখা গেছে। আকাশপথটা একটিমাত্র এয়ারলাইনের বন্ধনমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রেলপথে ভ্রমণ করে মানুষ আবিষ্কার অভিযানের মতোই তৃপ্ত হয়েছে, বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গিয়ে একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। অর্থনীতির রক্তস্পন্দনও ছিল রেলপথ, যার ফলে ‘লৌহ খনির কাছেই হতে হবে ইস্পাত কারখানা’ নিয়মটি প্রয়োজনহীন হয়ে গেছে। মৌসুমি খাদ্যাভাবে ভারতের যেসব এলাকা জর্জরিত হওয়ার উপক্রম হয় সেখানে খাদ্যশস্য নিয়ে যায় রেলপথ। কোনো কোনো সময় (পুরোপুরি মজা করবার জন্য নয়) বলা হয়, ভারতীয় জনগোষ্ঠীর ঐক্য ধরে রাখার কাজে যে কোনো সরকারের চেয়ে বেশি অবদান রাখছে বলিউড। গণমাধ্যমের শক্তিকে খাটো করে না দেখেও বলতে হয় যে, ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গন্তব্যপানে ধাবমান বাষ্পচালিত ট্রেন এবং পরবর্তী দশকগুলোয় বিদ্যুতায়িত ট্রেনগুলোকে দিয়ে আমাদের রেলপথ ঐক্য বজায় রাখার কাজটি বলিউডের চেয়ে বেশিই করেছে।

অধঃপতনের শুরুটা হয় সরকারের মধ্যকার ভেকধারী জনপ্রিয়দের কাছে গণইচ্ছার আত্মসমর্পণে। মৃত ব্যক্তির যতটা নিন্দিত হওয়া দরকার তার চেয়ে বেশি নিন্দা করবার প্রবণতায় ভুগি আমরা। তাই, আমি কারও নাম বলছি না। তবে এটা বলতেই হচ্ছে যে, নির্বাচনী এলাকা আর ওই এলাকার কিছু লোককে যাচ্ছেতাইভাবে তুষ্ট করবার জন্য রাজনীতিকরা রেলওয়ের মতো মুগ্ধকর ও রোমান্টিক একটা প্রতিষ্ঠানকে যে-ই ‘দক্ষিণা বিতরণের নল’ বানিয়ে ফেললেন সে-ই শুরু এর অধোগমন। লোক নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিণত হয়েছিল দয়া ও পক্ষপাতের মাধ্যমে আশীর্বাদ বর্ষণের যন্ত্রে। জনগণের সেবা করবার বদলে রাজনীতিকদের সেবা শুরু করে রেলপথ। রেলওয়ে বাজেট উত্থাপনের দিনটি একদা ছিল সংসদীয় ক্যালেন্ডারের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। সেই দিনটির গুরুত্ব কমতে কমতে তা নিজেকে নিজে মশকরার দিন হয়ে গেছে। নিরর্থক একটা ফর্মুলায় ভর করে রেলমন্ত্রীরা দায়সারা বাজেট ভাষণ দেন। রেলপথ ভুগছে দুরারোগ্য বিমারে অথচ মন্ত্রীরা দাওয়াই দেন নামকাওয়াস্তে। তারা ওষুধের দোকানের নামে অ্যাসপিরিন বড়ির দোকান খোলেন এবং আশা করেন যে, ব্যথাটি আড়াল করে রাখতে পারলে অসুস্থতা কারও চোখে ধরা পড়বে না। এ অবস্থার সঙ্গে যোগ হয় দীপাবলি উৎসবের আতশবাজি ফোটানোর মতো ওয়াদা আর ওয়াদা যেগুলোর অধিকাংশই ফাঁকা আওয়াজ। ব্যাপারটা ঠিক ‘বার্মিসাইড ফিস্ট’ (ভান-করা ভোজসভায় মেহমানদের কিছুই খেতে দেওয়া হয় না। তবু মেহমানরা তৃপ্তিতে খেয়েছেন ভান করেন, এমনকি ঢেঁকুর উঠেছে— এমন ভানও করা হয়) এর মতোই।  

সব মন্ত্রীই বার্মিসাইড, এ রকম বললে অন্যায় হবে। সবাই নন, তবে অনেকেই। দুই রেলমন্ত্রীর নাম মনে পড়ছে যারা ইতিবাচক কাজের জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন। একজন হলেন মাধরাও সিন্ধিয়া। তার উত্থাপিত রেলওয়ে বাজেট ছিল পরিচ্ছন্ন, গঠনমূলক ও অর্থবহ। আরেকজন দীনেশ ত্রিবেদী। ইনিও ভালো কিছু করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু হাত বাঁধা থাকায় বেশিদূর যেতে পারেননি। বর্তমান রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ আসবে— এটা তো স্বাভাবিক। যে ক্ষয় চলছে তা তাকে বন্ধ করতে হবে। শুধু তাই নয়, রেলপথের হতদশা পাল্টানোও তার কর্তব্য। অবনতি ঘটতে ঘটতে বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল, ওই মুহূর্তে দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি। তাকে তার পণ্যের মান উন্নত করতে হয়েছে এবং তা করেছেন নজিরবিহীন দ্রুততার সঙ্গে। কোচ, বগি, ট্রেন, রেললাইন, সেবার মান, পদ্ধতি ও স্টেশন ইত্যাদিতে হাত দিতে হয়েছে। আগে যেদিকে তাকানো গেছে শুধু সমস্যা আর সমস্যা। বিগত সরকারের জমানায় রেলপথ নিয়ে কী কী অনাচার হয়েছিল সেই ভীতিকর ব্যাপারগুলো এখন বার বার স্মরণ করার কোনো যুক্তি নেই। জনগণ সরকারকে নির্বাচন করে সমস্যাবলি সমাধান করার জন্য, অতীতের সমস্যা নিয়ে বিলাপ করার জন্য নয়। পূর্ববর্তী সরকার বিতিকিচ্ছি করাতেই তো নতুন সরকার এসে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। সুরেশ প্রভুর ঘোরতর সমালোচকরাও স্বীকার করলেন যে, সেবার মান ও পরিবেশ উন্নত হচ্ছে। এখন কয়েকশ শহরে ছড়িয়ে থাকা ৪০০ রেল স্টেশনকে তিনি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ছোট ছোট কেন্দ্রে পরিণত করলে তা হবে তার উজ্জ্বল সাফল্য। যেসব রেলরুটে যাত্রীঘনত্ব খুব বেশি সেগুলোয় বিশ্বমানের অত্যাধুনিক ট্রেন চালু করাটা কঠিনতর চ্যালেঞ্জ। এ জন্য লাগবে বিনিয়োগ। যারা মনে করেন, মুম্বাই ও আহমেদাবাদের মধ্যে হাইস্পিড ট্রেন সার্ভিস চালু করাটা অন্যায় হবে, তাদের মনে রাখা দরকার, রেলপথ বিদ্যুতায়নের কাজ সব জায়গায় একই সময়ে শুরু হয়নি। রেলপথের কাজকারবার বিরাট, তাই বিনিয়োগও করা চাই বিরাট। সেই বিনিয়োগ প্রধানত বিদেশ থেকে আনা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ জন্য জাপানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে কথাবার্তা বলে রেখেছেন। তা সত্ত্বেও কঠিন কঠিন অনেক কাজ এখনো বাকি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর