১৯ মার্চ, ২০১৬ ১১:৩৮

ইউরিকো নেই, তিনি আছেন বাংলাদেশের জনচিত্তে

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

ইউরিকো নেই, তিনি আছেন বাংলাদেশের জনচিত্তে

ইউরিকো কাওয়ামুরো। জাপানি মহিলা। ১৮ বছর আগে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। আজো জীবন্ত তিনি বাংলাদেশের বহু মানুষের স্মৃতিতে। মানবতার সেবায় তার অবদান তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে। মমতাময়ী ইউরিকো ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে সবান্ধব বেড়াতে এসেছিলেন। এখানে-ওখানে ঘুরতে ঘুরতে সবুজ-শ্যামল এই দেশটাকে ভালোবেসে ফেললেন। মনস্থ করলেন এ দেশের অনাথ দুস্থ শিশুদের কল্যাণে কাজ করবেন। জাপানে তার একটা সেবা প্রতিষ্ঠান আছে— ইন্টারন্যাশনাল অ্যাঞ্জেল অ্যাসোসিয়েশন (আইএএ)। বাংলাদেশে তেমন একটি প্রতিষ্ঠান করতে মন চাইল। কিন্তু ভাষা? তিনি তো বাংলা জানেন না। ঘটনাক্রমে এ সময় মো. আজিজুল বারী নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে ইউরিকোর পরিচয় হয়। বারীর কাছে নিজের আইডিয়া তুলে ধরলেন। সেই যে জড়িয়ে পড়লেন বারী, আজো রয়ে গেলেন। আজিজুল বারী এখন ইউরিকোর বাংলাদেশে গড়া আইএএর ডিরেক্টর। আজিজুল বারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইউরিকোর দ্বিতীয় মেয়ে নাওকো ছোটবেলায় প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়েছিল। ইউরিকো মেয়ের কষ্ট দেখেন আর ভাবেন, পৃথিবীর আরও কত মানুষ এর চেয়ে অনেক বেশি কষ্টে আছে। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত জাপানের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তো দেখেছিলেন সে দেশের হিয়োগো জেলার ইতোমি শহরে জন্ম নেওয়া ইউরিকো। তাই তিনি বিশ্বজুড়ে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়ার ভাবনা থেকেই শুরু করেন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাঞ্জেল অ্যাসোসিয়েশনের কাজ। তার বন্ধু-বান্ধব ও কাছের মানুষজন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ইতোমি শহরে যাত্রা শুরু করে অ্যাঞ্জেল অ্যাসোসিয়েশন। শুরুর দিকে পুরনো কাপড়-চোপড় জোগাড় করে সেগুলো বিক্রি করে সংগঠনের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতেন ইউরিকো। আজিজুল বারীর সহযোগিতায় ১৯৮৬ সালে মিরপুরের ১২ নম্বর সেকশনের ছোট্ট একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে কাজ শুরু করে আইএএ। এখানে ১২টি অনাথ শিশুর দেখাশোনা হতো। ১৯৮৮ সালে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে ৪৬ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হয় শিশু সদন। এখানে গরিব ও মেধাবীদের জন্য রয়েছে ছাত্রকল্যাণ বৃত্তি। রয়েছে হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। রয়েছে পাঠাগার, নারী শিক্ষা কার্যক্রম, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। রয়েছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রও। রয়েছে একটি ইউরিকো অ্যাঞ্জেল স্কুল, মহিলা কল্যাণ কেন্দ্র, মহিলা কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বিদ্যালয় নির্মাণ, স্যানিটেশন কার্যক্রম। ইউরিকো স্কুলে ৪১০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ইউরিকো স্কুলের ভিতরে ‘সততা স্টোর’ নামে একটি দোকান আছে। দোকানে কোনো বিক্রেতা নেই। জিনিসপত্র সাজানো রয়েছে। যার যা পছন্দ ইচ্ছামতো নিচ্ছেন, দামটাও রেখে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ জনের মতো অনাথ ও অসহায় ছেলেমেয়েকে নতুন জীবনের দিশা দিয়েছে এই শিশু সদন। এখানকার বাসিন্দাদের থাকা-খাওয়া, পড়ালেখা সবকিছু সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। শিশু সদনে বেড়ে ওঠা অনেকেরই কাজের সুযোগ হয়েছে আইএএর বিভিন্ন শাখায়। এমনকি বিদেশে বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনার সুযোগও রয়েছে। বর্তমানে ২০টি ছেলে ও ২০টি মেয়ে রয়েছে। এ ছাড়া ২৩ জন অ্যাঞ্জেলের বাইরে থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ইউরিকোর অ্যাঞ্জেল অ্যাসোসিয়েশন সারা দেশে অর্ধশতাধিক স্কুল ভবন তৈরি করেছে। স্থাপন করেছে শতাধিক নলকূপ ও টয়লেট। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাঞ্জেল অ্যাসোসিয়েশন থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১০ হাজারের বেশি নারী-শিশুকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কোনাবাড়ীর এই কেন্দ্র ছাড়াও কাপাসিয়ার সূর্যনারায়ণপুরে রয়েছে আরও একটি কেন্দ্র। মমতাময়ী জাপানি নারী ইউরিকো কাওয়ামুরো এখন শুধুই ছবি। ২০০৪ সালের ২৩ নভেম্বর তিনি মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার মেয়ে মারিকো হিগাশিমুরা প্রতিষ্ঠানের দেখভাল করছেন। মারিকো বছরের বেশির ভাগ সময় জাপানে থাকলেও মায়ের স্মৃতিধন্য প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করেন।  ইন্টারন্যাশনাল অ্যাঞ্জেল অ্যাসোসিয়েশনের ভিতরে মূল ভবনের সামনেই রয়েছে ইউরিকোর স্মৃতিসৌধ। আর এই স্মৃতিসৌধে খোদাই করে লেখা, ‘শান্তির পৃথিবীর প্রার্থনায়-সমুদ্র পাড়ি দেয় মানুষ— ভালোবাসা পাড়ি দেয় দেশ থেকে দেশে’।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর