২৬ মার্চ, ২০১৬ ১৪:১০

অনেক অর্জন থাকলেও বৈষম্য দূর হয়নি

জিন্নাতুন নূর

অনেক অর্জন থাকলেও বৈষম্য দূর হয়নি

স্বাধীনতার ৪৫ বছর পূর্তিতে রাষ্ট্র হিসেবে গর্ব করার মতো অনেক কিছুই বাংলাদেশ অর্জন করেছে। আমরা বাংলা ভাষা পেয়েছি। আন্তর্জাতিক বিশ্বে দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছি। এর আগে বাংলাদেশ ছিল একটি প্রান্তিক রাষ্ট্র। আর এখন এটি আত্মমর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সারা পৃথিবীতে আমাদের যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের দেশের বাইরে গিয়ে কাজের সুযোগ মিলছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রাখছেন এ দেশের মানুষ। 

শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, শিক্ষায় আমাদের বড় রকমের বিস্তার ঘটেছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার বিস্তার গৌরবজনক। নারীরা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে গিয়েও নিজেদের কর্মদক্ষতা প্রমাণ করছেন। এর বাইরে উন্নয়নমূলক কাজে ও অবকাঠামোগতভাবে, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সড়কপথেও আমাদের বড় অর্জন আছে। আগের তুলনায় যানবাহনের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এই ৪৫ বছরে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু বৈষম্য দূর হয়নি। সমাজে তিন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। যা বলে দিচ্ছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে এখনো বৈষম্যহীন সমাজ অর্জন করতে পারেনি। 

এই প্রাবন্ধিক আরও বলেন, আমাদের ধনী-গরিব, নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য দূর করতে হবে। লক্ষ্য করেছি যে, নারীর নিরাপত্তা বাড়েনি বরং আগের চেয়ে কমেছে। এখন নারীদের যে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনাগুলো ঘটছে তা আগে দেখা যায়নি। বর্তমানে যে পরিমাণ নারী বোরকা বা হিজাব ব্যবহার করছেন তা পাকিস্তান আমলেও তারা করেনি। মূলত নিরাপত্তাহীনতার কারণেই নারী এখন আগের চেয়ে বেশি বোরকা বা হিজাব ব্যবহার করছেন। বিভিন্ন সামাজিক সূচকে এগিয়ে যাওয়ার পরও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এখনো নেতিবাচক রয়ে গেছে বলে এই প্রাবন্ধিক মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সূচক যেমন— দুর্নীতি, পরিবেশ ও নারীর নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও এই সূচকগুলোতে আমরা নিচের দিকে অবস্থান করছি। এমনকি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের যে অগ্রগতি তা সন্তোষজনক নয়। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমরা যখন স্বাধীনতা লাভ করি সে সময় থাইল্যান্ড ও কোরিয়া এসব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের তুলনায় খারাপ ছিল। আমরা এই দেশগুলোর চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে ছিলাম। কিন্তু এত বছর পর আজ ওই দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে; কিন্তু আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশের মানুষ এখন মালয়েশিয়ায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যাচ্ছে। সেখানে কাজ করার সুযোগ না পেয়ে নিজেদের ‘দুর্ভাগা’ বলেও মনে করছে। অথচ এই শ্রমিকদের বাংলাদেশেই কাজ করার কথা ছিল; কিন্তু তা হয়নি। এর কারণ দেশে বিনিয়োগ বাড়েনি। জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি থেকে ১৬ কোটি হয়েছে তবে সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান হয়নি। শিক্ষিত লোকদের বেকারত্ব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এর ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে সহিংসতা, খুন, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। বেকার যুবকরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। শ্রমজীবীরাও মাদক গ্রহণ করছে।  তিনি বলেন, স্বাধীনতা লাভের আগে পরাধীন বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি স্বপ্ন ছিল। এর মধ্যে আমাদের কয়েকটি স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা পেয়েছি। কিন্তু ‘মুক্তি’ পাব বলে যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, তা এখনো পূরণ হয়নি। সেখানে অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে। আমাদের বুঝতে হবে, মুক্তির স্বপ্ন কেবল রাজনৈতিক মুক্তি বা অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, আমাদের এমন এক সমাজ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সব ধরনের বৈষম্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, বাংলাদেশের সামনে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ আছে। এর মধ্যে শিক্ষার চ্যালেঞ্জ বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, আমরা শিক্ষাকে সার্বজনীন করতে পেরেছি, কিন্তু এর মান উন্নয়ন করতে পারছি না।

যদি মাতৃভাষাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হতো তবে তিন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা আর থাকত না। এ জন্য অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।

এই অধ্যাপক বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গি তত্পরতা পাকিস্তান আমলের চেয়েও এখন বেশি। এ ছাড়া রাষ্ট্র ধর্মের বিষয়টি সংবিধানের মৌলিক চরিত্রের সঙ্গে মেলে না। আমাদের সংবিধানে সবার সমান অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু রাষ্ট্রের যদি নিজস্ব ধর্ম থাকে তবে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত হবে না।

এই শিক্ষাবিদ বলেন, আমাদের বর্তমান সমস্যা পুঁজিবাদি উন্নতি নিয়ে। এই পুঁজিবাদি উন্নতি বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে। মানুষ এখন নিজের স্বার্থ নিয়ে বেশি ভাবছে, তাদের দেশপ্রেম কমে যাচ্ছে। অথচ একাত্তরে চরম বিপদের সময়ও মুক্তিযোদ্ধারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। তাদের মধ্যে সে সময় বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়নি। বিপদ আছে জেনেও তখন সাধারণ মানুষ শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এ জন্য বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কর্তব্য হবে দেশের স্বার্থে সংকীর্ণতা ও বিচ্ছিন্নতার বাইরে সমষ্টিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। এই উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের উন্নতি সম্ভব। একই সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন করতে হবে। এর অর্থ এই যে, এমন এক সমাজ গড়তে হবে যেখানে ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ ও আঞ্চলিক বৈষম্য থাকবে না। আর এমনটি নিশ্চিত করতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।


বিডি-প্রতিদিন/ ২৬ মার্চ, ২০১৬/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর