২৭ মার্চ, ২০১৬ ২০:০৬
লেখকের অন্য চোখ

স্রোতে ভাসছি ভাসতেই হবে

সমরেশ মজুমদার

স্রোতে ভাসছি ভাসতেই হবে

কয়েক বছর হলো পুজো আসছে ভাবলেই অস্বস্তি শুরু হচ্ছে। কাজকর্ম ফেলে কোনো বনবাদাড়ে গিয়ে যে বসে থাকব তাও সব সময় হয়ে ওঠে না। আমি থাকি শ্যামবাজারে। দুদিকে দুটো বড় রাস্তা, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট আর চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ। গোটা বছর প্রথম রাস্তা দিয়ে সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফিরতাম। পুজোর দেড় মাস আগে এক সন্ধ্যায় রংমহল থিয়েটারের কাছে এসে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। কুড়ি মিনিটেও যখন চাকা নড়ল না তখন ড্রাইভার খবর নিয়ে এসে জানাল, ‘হাতিবাগানে রাত ১০টার আগে গাড়ি যাবে না। পাবলিক পুজোর বাজার করছে।’ অর্থাৎ একটি বড় রাস্তা পুজো আসছে বলে আমাদের এড়িয়ে যেতে হবে। ভরসা একমাত্র চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ। কিন্তু পুজো যখন ১৫ দিন পরে তখন দুপুরে ওই রাস্তায় পৌঁছে দেখা গেল সামনের গাড়ির ডিকির লাগোয়া পেছনের গাড়ির বনেট শান্তিতে রয়েছে। এই জ্যাম চলবে দশমী পর্যন্ত। রোজ তো এত গাড়ি থাকে না। হঠাৎ কেন? ড্রাইভার জানাল, সবাই পুজোর বাজার করতে বেরিয়েছে। কোয়েস্ট মল থেকে সাউথ সিটি যাচ্ছে সবাই। অর্থাৎ মহালয়া পর্যন্ত গাড়ি বের করার কোনো মানেই হয় না। আর তারপর থেকে দশমী পর্যন্ত দিন-রাত ঠাকুর দেখার ভিড় শুরু হয়ে যাবে। সেই ভিড়ের চেহারা বড় হবে মফস্বলের দর্শনার্থীদের জন্য। এ সময় কারও অসুস্থ হওয়া নিষিদ্ধ। কারণ তাকে হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা বিফল হবে। অতএব, নিজের গাড়ি ছেড়ে বাধ্য হয়ে অটোকে হাত দেখাতে হলো। উল্টোডাঙায় যাব। লোকটা বলল, ‘উঠুন কিন্তু ৩০ টাকা দিতে হবে।’

‘আমি শেয়ারে যাব ভাই, ফুল অটো নয়।’

‘তিনজন তো পিছনে বসে আছে দেখছেন। পুজোর সময় ভাড়া ৩০ হয়ে গেছে।’

‘সে কী! কাগজে তো পড়িনি।’

অটোচালক এমনভাবে তাকাল যে, মনে হলো আমার মতো উজবুক লোক সে জীবনে দেখেনি। কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে আর একজন যাত্রী পেয়ে গেল সে।

পুজো আসছে বলে ৮-১০ টাকার বদলে ৩০ চাইছে? প্রশাসন বলে কিছু নেই! রাস্তার মোড়ে ‘কেপি’ লেখা বাইকের পাশে উদাসীন ভঙ্গিতে দাঁড়ানো সার্জেনের কাছে গিয়ে ব্যাপারটা বললাম। শোনার পর তিনি বললেন, ‘তো?’

‘লোকটা বেআইনিভাবে বেশি ভাড়া চাইছে। কিছু করুন।’

সঙ্গে সঙ্গে সার্জেন ওয়াকিটকি বের করে মাথা নাড়তে নাড়তে কথা বলা শুরু করলেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর নিজেকে এক ধরনের গবেট বলে মনে হলো।

একটা খালি ট্যাক্সি আসছিল। দেখে চিত্ত জুড়িয়ে গেল। যত জ্যামই হোক ৪০ টাকার বেশি মিটারে উঠবে না। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘যাবেন?’

‘আপনাদের সেবায় তো বেরিয়েছি স্যার। কাউকে রিফিউজ করি না।’

‘না, খুব জ্যাম তো। দরজা খুলে সিটে বসে বললাম, উল্টোডাঙায় যাব।’

‘নিশ্চয়ই। মিটারে যা উঠবে তার উপরে একটু বোনাস দিতে হবে, স্যার।’

‘বোনাস?’ হকচকিয়ে গেলাম।

‘আমাদের তো চাকরি-বাকরি নেই অথচ পুজো আসছে। সবাইকে জামা-কাপড় দিতে হবে। আপনারাই তো মালিক, তাই আপনাদের কাছ থেকে বোনাস চেয়ে নিচ্ছি। বেশি নয়, ৩০ টাকা দিলেই খুশি হব, ওটা দিতে নিশ্চয়ই আপনার কষ্ট হবে না।’

উল্টোডাঙা পৌঁছেছিলাম। ১০ মিনিটের রাস্তা আধঘণ্টায়। তখন আফসোস হচ্ছিল, অটোয় উঠলে ৩০ টাকায় পৌঁছানো যেত।

বাজারে গিয়ে দাম শুনে মাছওয়ালার দিকে তাকালাম। লোকটা লজ্জা-লজ্জা হাসি হাসল, পুজোর বাজার স্যার, সাপ্লাই কম, বেশি দামে কিনতে হচ্ছে তো। আচ্ছা আপনি পাঁচ টাকা কম দেবেন।

বাড়ি এসে বললাম, ‘এই কদিন মাছ খাব না।’

অসম্ভব। পুজোর চার দিন নিরামিষ? এক দিন তো হয়ই। সমস্বরে প্রতিবাদ হলো।

কিছু করার নেই। স্রোতে ভাসছি। ভাসতেই হবে। পাড়ায় দু-দুটো পুজো। খুব আকচা-আকচি। গত বছরও দুশো করে চাঁদা দিয়েছি।

এবার হাজার করে চাইল। চোখ কপালে তুলে বলল, ‘এবার দশ-বিশ টাকা যারা দিত, তাদের বাদ দিয়েছি। ওই টাকার জন্য অত ঘোরাঘুরি পোষায় না। তাই আপনাদের কাছে আবেদন রাখছি।’

‘আমি কোত্থেকে দেব?’

‘ছিঃ। এ কথা বলবেন না। আপনি আমাদের পাড়ার গর্ব। ছেলেটি গলা নামাল, তা ছাড়া আর একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে যে।’

‘সর্বনাশ? কে করল?’

‘আর বলবেন না। সিবিআই।’

‘অ্যা?’

‘বলছি কি! যারা আগে স্পন্সর করত তারা সিবিআইয়ের ভয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছে অথচ বাজেট কমাতে পারছি না আমরা। ওই সারদার জন্য ডুবে গেলাম। তাই আপনারা যদি এগিয়ে না আসেন তাহলে ভাসব কী করে বলুন!’


 

বিডি-প্রতিদিন/ ২৭ মার্চ, ২০১৬/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর