শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

নারায়ণগঞ্জের গর্ব রাইফেল ক্লাব

রোমান চৌধুরী সুমন, নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জের গর্ব রাইফেল ক্লাব

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর‌্যায়ে শুটিং প্রতিযোগিতায় সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে ঐতিহ্যবাহী নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব। ক্লাবটি নারায়ণগঞ্জের গর্ব। এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর‌্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ৩টি সোনা, ২টি রুপা এবং জাতীয় পর‌্যায়ে ৯টি সোনা, ৩টি রুপা ও ৪টি ব্রোঞ্জ ক্লাবের ঝুলিতে জমা হয়েছে। শুধু শুটিংই নয়, দেশের ক্রিকেটের ইতিহাসেও রয়েছে ক্লাবটির উল্লেখযোগ্য অবদান। এ ছাড়া মহান স্বাধীনতা সংগ্রামেও রয়েছে এ ক্লাবের গৌরবময় অতীত। মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্লাবের অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। যে কারণে দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় এ ক্লাবটির নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে সোনার অক্ষরে। তবে ক্লাব কর্তৃপক্ষের মতে, সহযোগিতা পেলে ক্রীড়াঙ্গনে ক্লাবটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর‌্যায়ে যুগোপযোগী অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

গত শতকের পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে প্রতিবেশী দুই বন্ধু জালাল উদ্দিন আহাম্মদ ও গোলাম রব্বানী খানের মনে নতুন কিছু করার উম্নাদনা জাগে। বয়োজ্যেষ্ঠরা তাদের পরামর্শ দিলেন এমন কিছু করার যা দীর্ঘদিন মানুষ মনে রাখবে। সে পরামর্শেই দুই বন্ধু মিলে গড়ে তুললেন নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব। তারপর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আজ ৬৫ বছরে পদাপর্ণ রাইফেল ক্লাবের। জম্নলগ্নে যাদের সহযোগিতা ক্লাবের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে তারা হলেন স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত (মরণোত্তর) রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এ কে এম শামসুজ্জোহা, ভাষাসৈনিক মরহুম আজগর হোসেন ভ‚ঁইয়া, মরহুম আবদুল হামিদ, ভাষাসৈনিক মরহুম বজলুর রহমান এবং ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব শতবর্ষী এম এ মোতালেব। ১৯৫০ সালে ক্লাবটি প্রতিষ্ঠার পর শুরু হয় প্রশিক্ষণ। পরে ক্লাবের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন মো. শহীদ মিয়া, মরহুম শহীদ আলী আক্তার, মো. হাবিবুর রহমান (জামাই নামে পরিচিত), বিশিষ্ট পাট ব্যবসায়ী মরহুম এস এ খায়ের, মরহুম আফাজ উদ্দিন ফকির, মরহুম গোলাম আম্বিয়া ফকির, বাবু নিত্য গোপাল সাহা। ১৯৬৪ সালে জাপান অলিম্পিকে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করে এ ক্লাব। ষাটের দশকে ক্লাবের সুনাম আকাশচুম্বী হতে থাকে। শুটার মরহুম হাসান জামাল, হাসান রেজা, মো. শহীদ মিয়া, শহীদ আলী আক্তার, জাকিয়া সুলতানা, এমরাতুন জামাল, আনিসা তাহের, সালাতারা, মনোয়ারা বেগম (নানী), ক্যাপ্টেন সেলিম মাহমুদ, মীর শাহজাহান, প্রয়াত কাজী সেলিমের পদচারণে শুটিং ক্রীড়ায় নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করে। স্বাধীনতা-পরবর্তীতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ, আনুষঙ্গিক শুটিং উপকরণ সংগ্রহ করে পুনরায় শুটিং শুরু হয় ১৯৭৭ সালে। জাতীয় প্রতিযোগিতায় যেমন সফলতা আসতে থাকে, তেমনি সফলতা আসতে থাকে আন্তর্জাতিক পর‌্যায়ে। সফলতার প্রথম অর্জন ক্লাবের ঝুলিতে আসে । ১৯৯১ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে এ ক্লাবের শুটার শাহানা পারভীন দেশের পক্ষে সোনা জয় করেন। ১৯৯৯ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে দলগতভবে লাভলী চৌধুরী আঁখি দ্বিতীয়বার সোনা ও ২০০০ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সাফ শুটিং প্রতিযোগিতায় আনোয়ারুজ্জামান সোনা জেতেন। এ ছাড়া ২০০৪ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত নবম সাফ গেমসে আনোয়ারুজ্জামান ও সুরাইয়া আক্তার রুপা জয় করেন। এ ছাড়া শুটার আরমিন আশা ৫ বছর যাবৎ জাতীয় পর‌্যায়ে এয়ার পিস্তল শুটিং প্রতিযোগিতায় সোনা জিতে আসছেন এবং বেশ কয়েকবার জাতীয় রেকর্ড গড়েছেন।

গত জুনে অনুষ্ঠিত ২৭তম জাতীয় শুটিং প্রতিযোগিতায় ক্লাবের নবাগত শুটার জেসিমুজ্জামান হিমেল ২টি সোনা, ১টি ব্রোঞ্জ; সুরাইয়া আক্তার ১টি সোনা; আরমিন আশা ১টি রুপা; রিসালাতুল ইসলাম ১টি রুপা; স্বরূপ চৌধুরী ১টি ব্রোঞ্জ ও তানহিয়াত তাবাস্সুম তাহা ১টি ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন; যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক পদক। ২০১৪ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের ব্যবস্থাপনায় ষষ্ঠ জাতীয় এয়ারগান চ্যাম্পিয়নশিপে নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের শুটার জেসিমুজ্জামান হিমেল ১০ মিটার এয়ার রাইফেল জুনিয়র সোনা; আরমিন আশা ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টে ১টি রুপা ও সুরাইয়া আক্তার ১০ মিটার এয়ার রাইফেল (মহিলা) ইভেন্টে ১টি ব্রোঞ্জ লাভ জেতেন। ১৯৮৭ সালে আন্তক্লাব শুটিং প্রতিযোগিতায় নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয়। ক্রিকেটে নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব ১৯৮২ সালে তার যাত্রা শুরু করে। ১৯৯৪ সালে আইসিসি ট্রফিতে রাইফেল ক্লাব টিমের খেলোয়াড় জাহাঙ্গীর আলম প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে শত রান করেন। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্যও ছিলেন তিনি। নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের আরেক সদস্য শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ দেশের হয়ে রেকর্ড করেছেন। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ দলে ছিলেন তিনি।

এ ছাড়াও ক্লাবের সদস্য ও শুটার মেজবাহউদ্দিন উসু প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে সাফ গেমসে সোনা জেতেন। বর্তমানে ক্লাবে উসুর নিয়মিত প্রশিক্ষণ চলছে।

শুটিং একটি ব্যয়বহুল খেলা। অস্ত্র, গোলাবারুদ ও শুটিংসামগ্রী কেনা বাবদ অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়। শুটারদের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য সম্মানী ভাতা প্রদান করতে হয়। বর্তমানে ক্লাবের পাঁচজন শুটার সম্মানী ভাতা পেয়ে আসছেন। সর্বনিæ ১২ হাজার এবং সর্বোচ্চ ২১ হাজার টাকা হারে পদক অনুযায়ী মাসিক সম্মানী ভাতা দেওয়া হয়। কাজী ইমরুল কায়েস ও মো. শফিকুজ্জামান শফিক কোচের দায়িত্ব পালন করছেন।

ভারতের আসামে অনুষ্ঠেয় ১২তম এস এ গেমস উপলক্ষে বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনে শুটিং প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের সাতজন শুটার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন।

সর্বশেষ খবর