সোমবার, ২৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

যে গৌরব শুধু বাংলাদেশের

আসিফ ইকবাল

যে গৌরব শুধু বাংলাদেশের

তারকা খ্যাতিতে পেলে, ম্যারাডোনা, মেসি কিংবা রোনাল্ডোদের ধারে কাছে নেই। ফুটবল বিশ্বে পরিচিতও নন। তারপরও জাকারিয়া পিন্টু, কাজী সালাউদ্দিন, এনায়েতরা যা করেছেন, পেলে, ম্যারাডোনা নন, পৃথিবীর কোনো ফুটবলার কখনোই স্পর্শ করতে পারবেন না পিন্টু, সালাউদ্দিনদের বিরল সেই কৃতিত্ব। বিশ্বযুদ্ধ কিংবা নিজ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন এমন ফুটবলারের সংখ্যা অনেক। কিন্তু একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জোট বেঁধে, একটি ‘দল’ হয়ে ফুটবল খেলার ইতিহাস নেই। ১৯৭১ সালে একদল বাঙালি ফুটবলার ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ নামে যুদ্ধ করেছেন। দল বেঁধে দেশ মাতৃকার ডাকে, একটি পতাকার জন্য, একটি ভুখণ্ডের জন্য মৃত্যু ভয়কে জয় করে যুদ্ধ করেছেন। এমন কৃতিত্ব শুধুই ফুটবলারদের। এমন গৌরব শুধুই বাংলাদেশের। এসব মৃত্যুঞ্জয়ী ফুটবলার বাংলাদেশের সোনালি ইতিহাসে বেঁচে থাকবেন আজীবন, অমলিন থাকবেন অনাধিকাল। হাজার বছরের সেরা সন্তান ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ফুটবলার।       

লন্ডন, মেলবোর্ন কিংবা ডানেডিন- যেখানেই মাশরাফি, সাকিবরা ক্রিকেট খেলেন, সেখানেই সুনীল আকাশে পতপত করে উড়তে থাকে লাল-সবুজ পতাকা। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সংগীত যখনই গাইতে থাকেন, তখনই হাজার হাজার মাইল দূরের ১৬ কোটি বাঙালির কণ্ঠের মাধুর্য ঢেলে তাদের সঙ্গে গাইতে থাকেন। অথচ ১৯৭১ সালে এমনটি ছিল না। ৪৭ বছর আগে একটি স্বাধীন ভুখণ্ড, একটি পতাকা, একটি জাতীয় সংগীতের জন্য পাকিস্তানের বিপক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিল সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সাড়ে ৯ মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধের পর স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। সেই যুদ্ধে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অবদান অবিস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সহায়তার জন্য বাংলাদেশের ফুটবলার ও সংগঠকরা একত্রিত হয়ে ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ নামে ভারতের আনাচে-কানাচে ফুটবল খেলেছেন। লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে জাতীয় সংগীত গেয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন গোটা দেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে যাওয়া একটি নাম ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’।

৪৭ বছর আগের স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। যারা আছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়গুলোকে লালন করে বেঁচে আছেন মাথা উঁচু করে। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার ও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য কাজী সালাউদ্দিন আবেগতাড়িত হয়ে সেজন্যই বলেন, ‘আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর একটি মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের জন্য কাজ করতে পারা।’ দলটির অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু বলেন, ‘আমার খেলোয়াড়ি জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এটা। আমি খুবই ভাগ্যবান যে, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেলতে পেরেছি এবং নেতৃত্ব দিয়েছি।’ মুক্তিযুদ্ধের সাড়ে ৯ মাস কেউ সম্মুখ সমরে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। কেউ গান শুনিয়ে উদ্বুব্ধ করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। কেউ ফুটবল খেলে। বাংলাদেশের ৩৫ জন ফুটবলযোদ্ধা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ফুটবল ম্যাচ খেলে দেশের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছেন। বিশ্ব ইতিহাসে এমনটি দেখা যায়নি কখনো। কোনো দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ফুটবলযোদ্ধা দেখা যায়নি। ইতিহাসের কোথাও লেখা নেই এমন ফুটবলযোদ্ধাদের কথা। ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ বিশ্ব ইতিহাসে একমাত্র যোদ্ধা, যারা দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। দলটির অনেকেই আজ বেঁচে নেই। অনেকেই আছেন আমজনতা হয়ে। যারা মারা গেছেন এবং ভালো অবস্থানে নেই, তাদের জন্য মন কাঁদে বাফুফে সভাপতি সালাউদ্দিনের, ‘মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়টার কথা আমৃত্যু মনে থাকবে। দেশের বাইরে থাকলেও মন কাঁদতো দেশের জন্য। আমরা একে অপরকে সবাই উৎসাহিত করতাম। আমরা ছিলাম একটি পরিবার হয়ে। আজ অনেকেই বেঁচে নেই। অনেকেই খুব ভালো অবস্থানে নেই। এসব ভেবে খুব কষ্ট পাই। দেখতে দেখতে ৪৭ বছর হয়ে গেছে। অথচ মনে হয়, এইতো সেদিন আমরা দেশের জন্য যুদ্ধ করছি।’

বাংলাদেশ এখন স্বাধীন একটি দেশ। বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে পরিচিত মুখ। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ চিরন্ময় হয়ে যাওয়া এক নাম।

স্বাধীন বাংলা দলের ফুটবলাররা

জাকারিয়া পিন্টু (অধিনায়ক), প্রতাপ শংকর হাজরা, কাজী সালাউদ্দিন, নওশেরুজ্জামান, লে. নুরুন্নবী, আইনুল হক, শেখ আশরাফ আলি, খোকন, লুত্ফর, অমলেশ সেন, হাকিম, আমিনুল ইসলাম সুরুজ, তসলিম, বিমল, সুভাষ চন্দ্র সাহা, মুজিবুর রহমান. কায়কোবাদ, সিরু, সাত্তার, সঞ্জিত, মোমেন জোয়ার্দার, সাইদুর রহমান প্যাটেল, পিয়ারা, এনায়েতুর রহমান খান, শাহাজাহান, অনিরুদ্ধ, নিহার, গোবিন্দ, কুণ্ডু, আলি ইমাম, মাহমুদ, আজব আলি ও লালু। কর্মকর্তা: লুত্ফর রহমান, তানভীর মাজহার ইসলাম তান্না (টিম ম্যানেজার), ননী বসাক (কোচ)।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর