শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইতিহাস বদলে দিচ্ছেন মারিয়া স্বপ্নারা

ক্রীড়া প্রতিবেদক

ইতিহাস বদলে দিচ্ছেন মারিয়া স্বপ্নারা

অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ জয়ী বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা দেশে ফিরেছেন। ট্রফি নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ক্যামেরায় বন্দী হলেন তারা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটবল খেলবেন এক সময় স্বপ্নই ছিল। সেই মেয়েরা এখন একের পর এক শিরোপা জিতে ফুটবলের ইতিহাস পাল্টে দিচ্ছে। একটা দেশের ফুটবল বলতে তো পুরুষ জাতীয় দলকে বোঝায়। ব্রাজিল, জার্মানি, ইতালি, আর্জেন্টিনা বা ফ্রান্স ফুটবলে পরিচিত লাভ করেছে বিশ্বকাপ জিতেই। যে ক্রোয়েশিয়াকে এত দিন অনেকেই চিনতেন না তারাও পরিচিত হয়েছে রাশিয়া বিশ্বকাপে রানার্স আপ হওয়ায়। এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান বা ইরান ফুটবলে খ্যাতি পেয়েছে বার বার বিশ্বকাপ খেলায়। ফুটবলে পুরুষ জাতীয় দলের সাফল্যই দেশ পরিচিত করার অন্যতম হাতিয়ার। বাংলাদেশে ফুটবলে এক সময়ে আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা থাকলেও কখনো বড় কোনো টুর্নামেন্টে ট্রফি জেতার কৃতিত্ব নেই। সেখানে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন দেখাটায় স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। এখন এতটাই সংকটাপন্ন অবস্থা যে বিশ্বকাপ নয়, এশিয়া কাপের বাছাই পর্ব খেলাটাই স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালেই মারদেকা কাপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয় বাংলাদেশের। ৪৫ বছরে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ পুরুষ জাতীয় দল অনেক ম্যাচেই অংশ নিয়েছে। কিন্তু সাফল্য খুবই কম।

১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে লাল দলের শিরোপাটায় ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি জয়। ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে চ্যালেঞ্জকাপ, ১৯৯৯ সাফ গেমসে সোনা, ২০০৩ ভুটান আমন্ত্রণমূলক ট্রফি, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ, ২০১০ সাফ গেমসে সোনা ও ২০১৫ সালে সিলেটে অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ পুরুষ ফুটবলে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। ৪৫ বছরে পুরুষ দলের সব মিলিয়ে ৭ বার শিরোপা জয়ের সাফল্য রয়েছে। এখন যে করুণ হাল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা নয়, সেমিতে খেলা স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। গত চার আসরে বাংলাদেশ গ্রুপ ম্যাচ খেলেই সাফ চ্যাম্পিয়ন থেকে বিদায় নিয়েছে। এবারও ঘরের মাঠে আশা জাগিয়ে সেমিফাইনাল খেলতে পারেনি জাতীয় দল।

ফুটবলে বাংলাদেশে যে জনপ্রিয়তা তা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে পুরুষ দলের ব্যর্থটায়। কিন্তু সব হতাশা দূর করে ফুটবলে ইতিহাস পাল্টে দিচ্ছেন নারী ফুটবলাররা। ভুটানে অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ট্রফি জিতে আরেকটি নতুন ইতিহাস লিখে ফেললেন মৌসুমী, মারিয়া, স্বপ্না, কৃষ্ণা, আঁখি, শামসুন্নাহর, মাছুরারা। ফাইনালে নেপালকে ১-০ গোলে হারিয়ে স্বপ্নের ট্রফি নিয়ে ঘরে ফিরেছেন বাংলার মেয়েরা। পুরুষ জাতীয় দল কোনো টুর্নামেন্টে নামার আগে এখন একটাই কথা বলেন, চেষ্টা করব ভালো খেলার। আর মেয়েরা বলেন, শিরোপা ছাড়া কিছুই ভাবছি না। মারিয়ারা যা বলেন তা তারা বার বার করে দেখিয়ে দিচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশে মেয়েদের ফুটবলে যাত্রা বেশিদিনের নয়। আশি দশকে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার ব্যবস্থাপনায় মেয়েদের ফুটবলে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু ট্রেনিংয়ে সাড়া না পাওয়ায় তা অল্প দিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৩ সালে আবার নতুনভাবে যাত্রা হয়। আয়োজন করা হয় ঘরোয়া টুর্নামেন্ট। কিন্তু কম হুমকির সম্মুখীন হননি মেয়েরা। নারী ফুটবল বন্ধের দাবিতে বেশ কটি রাজনৈতিক দল আন্দোলনের হুমকি দিয়েছিল। ধানমন্ডি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের দেওয়ালে নারী ফুটবল বন্ধের দাবিতে পোস্টার ভরিয়ে দিয়েছিল। এমন হুমকির পরও থেমে থাকেননি মেয়েরা। তবে তাদের নিয়ে আবার শুরু হয় তিরস্কার। বলা হচ্ছিল ছেলেরাই যখন ফুটবলে দেশকে কিছু দিতে পারছে না সেখানে মেয়েদের ফুটবল খেলাটা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। যে মেয়েদের বলা হয়েছিল বলে লাথি মারা শিখতেই বছরের পর বছর পার হয়ে যাবে সেই মেয়েরাই এখন ফুটবলে লাল-সবুজের বিজয় নিশানা উড়াচ্ছে। ২০০৩ও যদি ধরা হয় তাহলে ফুটবলে মেয়েদের বয়স দাঁড়িয়েছে ১৫তে। এত অল্প সময়ে তারা ৭টি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। পুরুষরা যেখানে ৪৫ বছরে ৭ শিরোপা। মেয়েরা কি না মাত্র ১৫তেই ৭ ট্রফি জয়। এর চেয়ে বড় গৌরব আর কি হতে পারে। সাহস, জেদ, দেশপ্রেমই মেয়েদের বার বার সাফল্য এনে দিচ্ছে।

একেবারে অচেনা গ্রাম থেকে এসে সাবিনা, মারিয়া, কৃষ্ণারা এখন অল্প বয়সেই তারকা বনে গেছেন। বিদেশি কোচ ছাড়া নাকি  ফুটবলই চলে না। কিন্তু নারী ফুটবলে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। দেশি কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের প্রশিক্ষণেই অল্প সময়ে ৭ শিরোপা জিতেছে মেয়েরা। মারিয়াদের আজ যে সাফল্য  তা রূপ কথাকেও হারার মানায়। তার নেপথ্য নায়ক ছোটনই। এরপর আবার ম্যানেজার হিসেবে অভিজ্ঞ সংগঠক আমিরুল ইসলাম বাবুকে কাছে পাওয়ায় মেয়েদের আত্মবিশ্বাসটা নতুন মাত্রায় যোগ হয়েছে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে পুরুষ জাতীয় দলের সেমিফাইনাল খেলাটাই স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মেয়েদের সাফে হয় চ্যাম্পিয়ন না হয় রানার্সআপের ট্রফি হাতে তুলছেন কৃষ্ণা, মারিয়া ও স্বপ্নারা। পুরুষরা মাঝে মধ্যে ভাগ্যক্রমে গোল পেলেও মারিয়ারা যেন গোলের মেশিন। এক বছরেই মেয়েরা ১৯ ম্যাচ খেলে ১১০ গোল করেছে। এই রেকর্ড দক্ষিণ এশিয়া কেন নারী ফুটবলে বিশ্বে শক্তিশালী দেশগুলোও পারেনি। গোল যেখানে সোনার হরিণ, সেখানে পুরুষ ফুটবলে এখন হ্যাট্রটিকের প্রশ্নই উঠে না। অথচ মেয়েরা শুধু হ্যাটট্রিক নয়, সমানে ডাবল হ্যাটট্রিকও করছেন। সিরাত জাহান স্বপ্না অনূর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ডাবল হ্যাটট্রিক করেন। অর্থাৎ গোল করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মেয়েরা বিশ্ব রেকর্ডও গড়ে ফেলেছেন। মেয়েদের সাফল্যের রূপ কথা শুরু ২০১৫ সাল থেকেই। সেবার কাঠমান্ডুতে অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকা আঞ্চলিক পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। সেই থেকে শুরু। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ জিতেই মেয়েরা থেমে থাকতে চান না। তাদের চোখ বহুদূর। ফুটবলে বাংলাদেশের ইতিহাস যেভাবে মেয়েরা পাল্টে দিচ্ছে তাতে একদিন এশিয়া সেরার প্রত্যাশা করা যেতেই পারে।

সর্বশেষ খবর