সোমবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
তবু নীরব বাফুফে

রেফারিং নিয়ে বিতর্ক থেকেই যাচ্ছে!

ক্রীড়া প্রতিবেদক

রেফারিং নিয়ে বিতর্ক থেকেই যাচ্ছে!

১৯৭৮ সাল। ওই সময়ে ঘরোয়া ফুটবলে জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। লিগের প্রথম পর্বের ম্যাচে দুই জায়ান্ট ঢাকা আবাহনী-ঢাকা মোহামেডান মুখোমুখি। দুই দলের অধিনায়ক দুই ভাই মনোয়ার হোসেন নান্নু ও শামসুল আলম মঞ্জু। ম্যাচ শুরুর আগে অভূতপূর্ব এক দৃশ্য দেখা গেল। নান্নু ও মঞ্জুকে কাছে ডাকলেন রেফারি মুনীর হোসেন। গ্যালারি ভরা দর্শকদের চোখ সেই দিকে। রেফারি দুই অধিনায়ককে কি বলছেন। পড়ে বোঝা গেল মুনীর হোসেন দুই ভাইকে উপদেশ দিয়েছেন ফেয়ার প্লের। যদি মাঠে কেউ হট্টগোল করে সরাসরি লাল কার্ড দেখানো হবে।

এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রেফারির পক্ষে এমন হুঁশিয়ারি দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। শুধু মুনীর হোসেন কেন? ননী বসাক, জেড আলম, ঈসা খাঁ, মাসুদুর রহমান, দলিল খান, আর. আলমরা ছিলেন সেমানের রেফারি। ম্যাচ যত বড় বা গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন কন্ট্রোল করার ক্ষমতা রাখতেন। মাঠে অবৈধ চার্জে যেমন হলুদ কার্ড দেখানো হতো। আর অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করলে তো কথাই নেই সরাসরি লাল কার্ড দেখিয়ে বহিষ্কার করা হতো।

ঘরোয়া আসরে এখন যেমন তারকা ফুটবলারের দেখা মিলছে না। তেমনি মানসম্পন্ন রেফারির বড্ড অভাব। রফিকুল ইসলাম ও মনসুর আজাদ এই দুজনই ছিলেন বাংলাদেশের শেষ ভালো মানের রেফারি। এখন রেফারিং নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। অবশ্য আগেও রেফারিং নিয়ে অভিযোগ ছিল। বড় ম্যাচ হট্টগোলের কারণে পরিত্যক্তও হয়েছে। বিতর্ক এড়াতে সেসময়ে বিদেশি রেফারিও উড়িয়ে আনা হয়েছে। এশিয়ার বিখ্যাত রেফারি থাইল্যান্ডের প্রি ওয়াতানা আশির দশকে ঢাকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ পরিচালনা করে গেছেন। মালয়েশিয়া ও ভারত থেকেও রেফারি উড়িয়ে আনা হতো।

গত কয়েক বছর ধরে রেফারিং নিয়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্লাব ভিডিও ফুটেজ দেখিয়ে রেফারির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলেছে। বিস্ময় হলেও সত্যি কোনো কোনো অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। তবু বাফুফে নীরব ভূমিকা পালন করেছে। বিতর্ক এড়াতে বিদেশি রেফারির কথা তুললে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, আমাদের রেফারিরা বিদেশে খেলা পরিচালনা করে সুনাম কুড়াচ্ছেন। সেখানে ঘরোয়া আসরে বিদেশি রেফারি আনার প্রয়োজন নেই। কর্মকর্তারা বলছেন, কিন্তু বাংলাদেশের কোন রেফারি সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছেন সেই প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের ফুটবলে রুগ্ন দশায় ফুটবলারদের পারফরম্যান্স দায়ী করা যায়। তেমনি এর সঙ্গে রেফারিংও জড়িয়ে আছে। কেননা ঘরের মাঠে খেলোয়াড়রা দুর্বল রেফারিংয়ে খেলতে অভ্যস্ত। দেখা যাচ্ছে ওপরের নির্দেশে রেফারিরা বাধ্য হয়েই একটি দলের পক্ষে বাঁশি বাজাচ্ছেন। এ কথা বলা হচ্ছে দলগুলোর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে রেফারিরা সে পথে হাঁটে না। সেকারণে অফসাইড, ফাউল বা অন্যকিছু মাথায় চিন্তা থাকে না। ঘরোয়া ফুটবলে অফসাইডে থাকার পরও কোনো কোনো দল গোল পাচ্ছে। আবার গোল লাইন ক্রশ করার পরও কোনো কোনো দলকে গোলবঞ্চিত করা হচ্ছে। এই হচ্ছে ঘরোয়া আসরে রেফারিংয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। ফুটবলে কোনো মান নেই এরপরও ভালোবাসার টানে কেউ কেউ অঢেল অর্থ খরচ করে দল গড়ছে। লক্ষ্য ভালো ফুটবল ও জাগরণ। বাজে রেফারিংয়ের শিকার হলে এই উৎসাহ কি ধরে রাখা যাবে।

চলতি মৌসুমের প্রথম ট্রফি ফেডারেশন কাপে দুর্বল রেফারিং নিয়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে যাচ্ছে তাও আবার ফাইনালে। বসুন্ধরা কিংসকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ঢাকা আবাহনী আসরে শিরোপা ধরে রেখেছে। আবাহনীর সাফল্য বা জয় নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। ম্যাচের পরের দিনই বসুন্ধরা কিংস মিষ্টি ও ফুল পাঠিয়ে আবাহনীকে অভিনন্দন জানিয়েছে। যা ক্রীড়াঙ্গনে কখনো দেখা যায়নি। কিন্তু মিজানুর রহমানের দুর্বল রেফারিংয়ে ফাইনালের সৌন্দর্য যে নষ্ট হয়েছে এ নিয়ে সংশয় নেই। ঘরোয়া ফুটবল ইতিহাসে কোনো ফাইনালে এত দুর্বল রেফারিং চোখে পড়েনি।

খেলার শুরু থেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল রেফারি ফাউলের বাঁশি বাজাচ্ছেন কিংসের বিপক্ষে। আবাহনীর ফাউলও ধরা হয়েছে। কিন্তু কিংসের খেলোয়াড়রা চার্জ করলেই অধিকাংশ সময়ে ফাউলের বাঁশি বাজানো হয়েছে অকারণে। আক্রমণে গেলেই অফসাইড। কলিনড্রেসের গোলে বসুন্ধরা কিংস এগিয়ে যাওয়ার পরই বাঁশি বাজানোর প্রবণতা বেড়ে যায়। এতে যেমন ম্যাচের গতি হারাচ্ছে সেই সঙ্গে কিংসের খেলোয়াড়দেরও উত্তেজিত করার চেষ্টা চোখে পড়ছিল।

আবারও বলছি আবাহনীর শিরোপা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কৌশলী ফুটবল খেলে তারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। যত প্রশ্ন ও বিতর্ক রেফারিংকে ঘিরেই। একটা দলের বিরুদ্ধে যখন বার বার বাঁশি বাজানো হয় তখন কি তারা ঠাণ্ডা মাথায় খেলতে পারে? ফাইনালে বসুন্ধরা কিংসের অবস্থা তাই ছিল। শেষের দিকে কুংফু স্টাইলে যেভাবে খেলোয়াড়রা মারামারি করেছে তা ছিল লজ্জাকর। হয়তো কলিনড্রেস মনে মনে বলেই ফেলেছেন এজন্য তো বাংলাদেশের ফুটবলে করুণ অবস্থা।

মারামারির জন্য রেফারি আবাহনীর নাবীর নেওয়াজ জীবন, মামুন মিয়া, কিংসের সুমান্ত ত্রিপুরা ও তৌহিদুল আলম সবুজ এই চার ফুটবলারকে এক সঙ্গে লাল কার্ড দেখিয়ে বহিষ্কার করেন। ফুটবলে এ এক বিরল ঘটনায় বলা যায়। তবুও এতে রেফারির প্রশংসা করা যায় না। বরং বলা যায় তারই গাফলতির কারণে ঘটনা এত দূর গড়িয়েছে। শোনা যাচ্ছে শুধু লালকার্ড নয়, মাঠের শৃঙ্খলা ভাঙার কারণে চার ফুটবলারের আরও বড় শাস্তি হতে পারে। হোক এ নিয়ে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু রেফারি ও দুই সহকারী রেফারি কী রেহাই পেয়ে যাবেন? রেফারি মাঠের অভিভাবক। তিনি যদি ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারেন তারও কী শাস্তি হওয়া উচিত না? যোগ্যতা নেই, অথচ বিগ ম্যাচে বাঁশি বাজানোার দায়িত্ব  দেওয়া হচ্ছে। এভাবে কি চলবে দেশের ফুটবল?

 

সর্বশেষ খবর