ইংলিশদের কাছে ওয়ানডে ক্রিকেট যেন এক বিরক্তির নাম! মাঠে ৭-৮ ঘণ্টা ধৈর্য ধরে বসে থাকতে যেন বেশ আপত্তি তাদের! সে কারণেই টি-২০ তাদের বেশ জনপ্রিয়।
তাহলে টেস্টে গ্যালারি কানায় কানায় পূর্ণ থাকে কীভাবে? এমন প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক! আসলে টেস্ট ক্রিকেট হচ্ছে এক আভিজাত্যের নাম। এটি নিছক খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই! বাংলাদেশের যেমন উচ্চবিত্তরা নিজেদের আভিজাত্য প্রকাশ করতে শৌখিন গলফ খেলেন, আর ইংলিশ দেখেন টেস্ট! সে কারণেই টেস্ট এখানে বেশ জনপ্রিয়।
গতকাল বার্মিংহাম এজবাস্টন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে যখন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল চলছিল তখন স্টেডিয়ামের বাইরে থেকেই যেন বোঝার উপায় ছিল না। খা খা করছিল স্টেডিয়ামের চারপাশ। গ্যালারিও যে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল তা বলার উপায় নেই।অথচ এই মাঠে বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানের ম্যাচেও দেখা গেছে সারাক্ষণ উপচে পড়া ভিড়! একটি টিকিটের জন্য হাহাকার করেছেন সমর্থকরা। কাছে টিকিট নেই, তারপরও প্রিয় দলকে সমর্থন দিয়ে দূরের শহর থেকেও এসেছিলেন ভক্তরা।
আর এই ম্যাচে যেখানে স্বাগতিক ইংল্যান্ড লড়াই করেছে, সেখানে স্থানীয় দর্শকের আগ্রহ চোখে পড়ার মতো ছিল না। সেমিফাইনাল মহারণেও গ্যালারি বেশ কিছু আসন ফাঁকাই ছিল। বাইরে যে দুয়েকজনকে দেখা গেছে, তারা টিকিট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু কেনার মানুষ খুঁজে পাচ্ছেন না।
প্রথম সেমিফাইনালে ভারতের বিদায়ে যেন ক্রিকেটের ইমেজেই বড় ধাক্কা লেগেছে! এবারের বিশ্বকাপে ক্রিকেট নিয়ে ভারতীয় দর্শকদের উন্মাদনা ছিল চোখে পড়ার মতো। একটি ম্যাচ দেখার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন তারা। অনেকে কয়েকগুণ বেশি দামে টিকিটও কিনেছেন।
ম্যানচেস্টাওে হোটেলে পরিচয় হয়েছিল অঙ্কুর শর্মা ও কার্তিক প্যাটেলের সঙ্গে। দুই বন্ধুই কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। ক্রিকেটের টানে ইংল্যান্ড চলে এসেছেন। ভারত কোথায় সেমিফাইনাল খেলবে তা আগে থকে জানতেন না বলে দুটি সেমিফাইনালেরই টিকিটই কিনেছেন তারা। টিকিট পেয়েছেন ফাইনালেরও।
তাই ভারত হেরে যাওয়ায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন দুজনই। এমন হাজারো সমর্থক বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছিলেন ইংল্যান্ডে, শুধু ভারতের ক্রিকেটকে ভালোবেসে। ওল্ড ট্র্যাফোর্ড ক্রিকেট গ্রাউন্ডের বাইরে দেখা হয়েছিল ব্যঙ্গালুরুর ছেলে অনুপম ব্যানার্জির সঙ্গে। এখন থাকেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে কয়েক ঘণ্টা কাজ করে যে অর্থ উপার্জন করেন তারই কিছু অংশ রেখে দিয়েছিলেন ক্রিকেটের জন্য। সেমিফাইনালের টিকিট পাননি, তবু মাঠের বাইওে থেকে ভারতকে সমর্থন দিতে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল যদি বেশি দামেও কারও কাছে টিকিট পেয়ে যান, ঢুকে পড়বেন মাঠে। ভারত সেমিতে হেরে যাওয়ার পর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে অনুপম বলেন, ‘আমার জীবনে এর চেয়ে কষ্টা দিন আর নেই। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না ভারত এভাবে হেরে যাবে। আমি টিকিট পাইনি, তারপরও মোবাইলে খেলার আপডেট নিয়েছি এবং এই বাইরে বসেছিলাম। কিন্তু কি লাভ হলো?’
এই উন্মাদনা ছিল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দর্শকের মাঝেও। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খেলা দেখতে এসেছিলেন তারা। লর্ডসে যে ম্যাচে বাংলাদেশ পাকিস্তানের হেরে যায় সে ম্যাচের পর কথা হয়েছিল ফিরোজ তালুকদারের সঙ্গে। ঢাকার ছেলে এখন থাকেন জার্মানির মিউনিখে। লর্ডসের ম্যাচ মাশরাফিরের হারের পর হতাশ ফিরোজ আবেগে বলেছিলেন, ‘আমি আর কখনো ক্রিকেটই দেখব না! ভাই, এত কষ্ট করে আসলাম, কিন্তু এভাবে হেরে গেলাম আমরা! বাংলাদেশ সেমিতে যেতে পারেনি সেটা নিয়ে কষ্ট নেই, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হার নিয়েই আমার আক্ষেপ নেই, কষ্ট এখানেই যে কেন তারা এই ম্যাচে নিজেদের উজাড় করে দিয়ে লড়াই করল না! এমন ক্রিকেট দেখার জন্য কি আমরা এত দূর-দূরান্ত থেকে আসি?’
পাকিস্তানি সমর্থকদের আক্ষেপটা আরও বেশি! শেষ ম্যাচে জিতেও তারা শেষ চার নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে নিউইয়র্ক থেকে আসা পাকিস্তানি সমর্থক হাসান আলি সেমিফাইনালে ভারতকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু সেই ভারতও হেরে যাওয়ায় হতাশ তিনি। হাসান বলেন, ‘আমরা উপমহাদেশের মানুষরা ক্রিকেটকে যতটা প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি, ততটা আবেগ নেই ইউরোপ কিংবা অন্য দেশের মানুষদের। কিন্তু গতবারের মতো এবারও ফাইনালে উপমহাদেশের দেশ থাকবে না তা কি করে হয়! আমি খুবই হতাশ!’
অস্ট্রেলিয়ানদের ক্রিকেট আবেগও অনেকটা সীমিত। নিউজিল্যান্ডের তাই। এমনিতেই গ্যালারিতে তাদের দর্শক খুব একটা দেখা যায় না। যদিও ইংল্যান্ডে বসবাস করা তাদের লোকের সংখ্যা খুব কম নয়। আর ক্রিকেটকে ভালোবেসে অন্য কোনো দেশ থেকে খেলতে আসা দর্শক খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা!
তবে ইংলিশদের ওয়ানডে ক্রিকেট নিয়ে বিরক্তির বেশ কারণও আছে! এই দলটি ১৯৭৯, ১৯৮৭ এবং ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল। তিনবার ফাইনাল খেলেও শিরোপার দেখা পায়নি, হয়তো সে কারণেই হতাশ! তবে এবার ইংল্যান্ডের সামনে দারুণ এক সুযোগ। কাল সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে ৮ উইকেটে উড়িয়ে দিয়ে চতুর্থবারের মতো ফাইনাল নিশ্চিত করেছে। এখন দেখা দর্শকরা ক্রিকেট আবেগে উচ্ছ্বসিত হন কিনা!