শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ক্রিকেটে আত্মত্যাগের গল্প

শোক যখন লড়াইয়ের শক্তি

ক্রীড়াবিদরাও রক্তে মাংসে গড়া মানুষ! দুঃখ-কষ্ট তাদের হৃদয়কেও ক্ষত-বিক্ষত করে। কিন্তু সীমাহীন যন্ত্রণা দূরে ঠেলে দিয়ে দায়িত্ব-কর্তব্যে বলীয়ান হয়ে কিছু অ্যাথলেট আত্মত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নিজেকে মহামানবের কাতারে নিয়ে যান! এমন অতি মানবীয় ঘটনা আছে স্যার ডন ব্রাডম্যান, শচীন টেন্ডুলকার এমনকি ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলির ক্রিকেট ক্যারিয়ারে। এবার বিরল সেই তালিকায় যুক্ত হলো আরেক নাম- আকবর আলী! যার বীরত্বগাথায় বাংলাদেশ পেয়েছে প্রথমবারের মতো যুব বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ের অমৃত স্বাদ। ক্রিকেটে আত্মত্যাগের গল্প নিয়েই এই প্রতিবেদন। লিখেছেন মেজবাহ্-উল-হক

 

স্যার ডন ব্রাডম্যান

১৯৩৬-৩৭ মৌসুমের অ্যাশেজ সিরিজের ঘটনা। একদিন পরেই অ্যাডিলেড টেস্ট শুরু। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক স্যার ডন ব্রাডম্যান সন্ধ্যা পর্যন্ত সতীর্থদের সঙ্গে আলোচনা করেন ম্যাচের পরিকল্পনা নিয়ে। মর্যাদার লড়াইয়ে কিছুতেই হারা যাবে না ইংল্যান্ডের কাছে! দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ব্রাডম্যান। রাত ১১টায় বাড়ি ফেরার সময় হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামিয়ে সতীর্থদের বললেন, ছোট্ট একটা কাজ আছে! তারপর হাসপাতাল থেকে দ্রুত ঘুরেও এলেন। খুবই স্বাভাবিক ব্রাডম্যান। কাউকে কিছুই বুঝতে দিলেন না। পরের দিন পাওয়া যায়, ব্রাডম্যানের সন্তানের মৃত্যু সংবাদ। এমন ঘটনার মধ্য দিয়ে ব্রাডম্যান দায়িত্বশীলতার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন।

 

 

আকবর আলী

স্যার ডন ব্রাডম্যান, শচীন টেন্ডুলকার ও বিরাট কোহলির মতো দায়িত্ববোধের অনন্য এক নজির স্থাপন করেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক আকবর আলী। বড় বোন খাদিজা খাতুন খুবই ভালোবাসতেন আকবরকে। ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ছোট ভাইয়ের খেলা দেখেন। তারপর যমজ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। পরিবারের অন্য সদস্যরা ঘটনাটি আকবরকে জানায়নি। যদি ছেলে ভেঙে পড়েন। কিন্তু সেমিফাইনাল ম্যাচের আগে খবরটি শুনে বাড়িতে ফোন দিয়েছিলেন আকবর। ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। তবে দেশের প্রতি তার দায়িত্ব ভুলে যাননি। বরং বোনের মৃত্যুর শোককে শক্তিতে পরিণত করে ফাইনালে দায়িত্বশীল এক ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন বিশ্বকাপের শিরোপা। ম্যান অব দ্য ফাইনাল হয়েছেন। আকবরের হার না মানা ৪৩ রানের ইনিংসটি যেন স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে।

‘আইস-কুল’ থেকে দেশকে শিরোপা এনে দেওয়ায় আইসিসির সেরা একাদশে অধিনায়ক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন। বোনের মৃত্যু শোক কাটিয়ে এমন একটি অর্জনের জন্য ক্রিকেট বিশ্ব যেন আকবর আলীকে দিচ্ছে স্যালুট!

ব্রাডম্যান স্মরণীয় হয়ে আছেন টেস্টে তার ৯৯.৯৪ গড়ের জন্য। শচীন টেন্ডুলকারের আছে ‘সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি’। দুই গ্রেটকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে খেলে চলেছেন বিরাট কোহলি! আকবর আলীর পেশাদার ক্যারিয়ার এখনো শুরুই হয়নি। সামনে জাতীয় দলে খেলার চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশকে যুব বিশ্বকাপের শিরোপা এনে দেওয়া আকবর কী পারবেন নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা রেখে ব্রাডম্যান, টেন্ডুলকার, কোহলিদের পথ অনুসরণ করতে!

 

শচীন টেন্ডুলকার

বাবা রমেশ টেন্ডুলকারের সঙ্গে একটু বেশিই খাতির ছিল শচীন টেন্ডুলকারের! বাবা-ছেলে ছিলেন ক্লোজ বন্ধু। ঘটনাটি ১৯৯৯ বিশ্বকাপের। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা শচীন বিশ্বকাপ খেলতে ইংল্যান্ডে যান। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে  হেরে যায় ভারত। দ্বিতীয় ম্যাচে প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে। ম্যাচের দিন সকালে শচীন খবর পান, তার বাবা মারা গেছেন। মাঠে না গিয়ে সোজা এয়ারপোর্টে। বাড়ি ফেরেন ব্যাটিং জিনিয়াস। ওই ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ৩ রানে হেরে যায় ভারত। সুপার সিক্সের পথটা তখন কঠিন হয়ে যায় তাদের। দলের এমন পরিস্থিতিতে বাবার মৃত্যু শোককে ভুলে পরের দিনই বিমানে ওঠেন শচীন। পরের ম্যাচে কেনিয়ার বিরুদ্ধে খেললেন ১০১ বলে ১৪০ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। শচীনকে দেখে ভারতীয় দলের অন্য ক্রিকেটাররাও যেন উজ্জীবিত হয়ে যান।

তারপর শক্তিশালী ইংল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে সুপার-সিক্স নিশ্চিত করে ভারত। দেশের জন্য শচীনের এই ত্যাগ এখনো তরুণ ক্রিকেটারদের অনুপ্রেরণা জোগায়।

 

বিরাট কোহলি

বিরাট কোহলির বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে একদিন বড় ক্রিকেটার হবে। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই কোহলি নিরন্তর চেষ্টা করছিলেন। ২০০৬ সালে রনজি ট্রফির গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দিল্লির হয়ে কর্ণাটকের বিরুদ্ধে খেলছেন কোহলি। চার দিনের ম্যাচ। হঠাৎ তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সকালে প্রিয় বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে খেলতে গেলেন কোহলি। ৯০ রানের ইনিংস খেললেন। সন্ধ্যায় শুনতে পেলেন বাবা মারা গেছেন। পরিবারের সবাই কাঁদলেন কিন্তু কোহলি কাঁদেননি। ম্যাচে দিল্লি তখন বিপদে। তাই কোচকে অবাক করে দিয়ে পরের দিনই মাঠে নামলেন। দলকে বাঁচালেন বিপদ থেকে। সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মিডিয়ায় কোহলি বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পরের দিন আমি কোচকে বলি খেলব। জানি, তখন আমি না খেললে আমার দল বিপদে পড়বে। খেলা ছাড়া আমার কাছে অন্য কোনো উপায় ছিল না। আমার ভাইকে বলেছিলাম, বাবা স্বপ্ন দেখতেন একদিন আমি ভারতীয় দলে খেলব। দেখিস, আমি একদিন ঠিক ভারত জাতীয় দলের হয়েই খেলবই।’ সেদিনের সেই কোহলি আজকের ক্রিকেট বিশ্বের মহাতারকা।

সর্বশেষ খবর