ব্যাটিং কোচ নিল ম্যাকেঞ্জির কথা যেন ওষুধের মতো কাজ করেছে! একদিন আগে প্রিয় শিষ্য তামিম ইকবাল সম্পর্কে এই আফ্রিকান কোচ বলেছিলেন, ‘পাওয়ার প্লেতে তার আরও বাউন্ডারি মারা প্রয়োজন!’ গুরুর এই বচনেই যেন বেড়ে গেল তার শিষ্যের শৌর্য!
যে তামিম আগের ম্যাচে পাওয়ার প্লেতে মাত্র একটি বাউন্ডারি হাঁকিয়েছিলেন, সেই তিনিই কিনা কাল চারের ফুলঝুড়ি ছোটালেন। খেললেন ১৫৮ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস। তার ইনিংসে ছিল ২০টি চারের মার, যার মধ্যে পাওয়ার প্লেতেই ১০টি! ড্যাসিং ওপেনারের ইনিংসে ছিল ৩টি বিশাল ছক্কাও।
নিজের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ভেঙে গড়লেন নতুন আরেক রেকর্ড। ২০০৯ সালে বুলাওয়েতে এই জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধেই তামিম করেছিলেন ১৫৪ রান। কাল সেটিকেও টপকে গেলেন। এর আগে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান দেড়শও ছাড়াতে পারেননি। সর্বোচ্চ মুশফিকের ছিল ১৪৪ রান, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে।আর তামিমের রেকর্ডের দিনে আফ্রিকা মহাদেশের দলটির বিরুদ্ধে ৩২২ রান করে দলীয় সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়ল টিম বাংলাদেশও। আগের ম্যাচে ৩২১ রান করে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে নতুন রেকর্ড গড়েছিল টাইগাররা! কাল সেটিকে আরেকবার ছাড়িয়ে গেলেন টাইগাররা।
তামিম সেঞ্চুরির ‘ল্যান্ডমার্কে’ পৌঁছে যান উইলিয়ামসের বল ডিপ কাভারে ঠেলে দিয়ে। ২০৬ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের এটি তার ১২তম শতক। সেঞ্চুরি পেতে তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে ১০৬টি বল। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে সিরিজের প্রথম ম্যাচে ৪৩ বলে ২৪ রান করা ড্যাসিং ওপেনার কাল হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলেন মাত্র ৪২ বলে। পরের ৫০ রান করেছেন ৬৪ বলে। শেষের ফিফটি মাত্র ২৪ বলে।
কালকের তামিমকে কিছুতেই মেলানো যাচ্ছিল না গত কয়েক মাসের তামিমের সঙ্গে! ইনিংসের প্রথম বল থেকেই যেন ‘অগ্নিমূর্তি’ ধারণ করেছিলেন দেশসেরা ওপেনার। নিজেকে খোলস থেকে মুক্ত করে ফিরে গিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন পুরনো চেহেরায়। এ যেন সেই তামিম যাকে দেখে বোলারদের কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যেত!
তবে সেঞ্চুরির কাছে গিয়ে বেশ সতর্ক হয়ে যান। তাই স্লো হয়ে যায় তার ব্যাটিং। সেঞ্চুরির জন্য তামিম এতটাই মরিয়া হয়েছিলেন যে শেষের ৭ রান করতেই তিনি খেলেন ১৭ বল।
কাল তামিমের ইনিংসে লক্ষণীয় দিক ছিল, হাফ সেঞ্চুরি কিংবা সেঞ্চুরির পর তিনি সেলিব্রেশন করেননি। শতক পূরণের পর তামিম দেখে মনে হয়েছে, যেন হাফ সেরে বাঁচলেন! হেলমেট খোলেননি, এমনকি হাত উঁড়িয়ে ব্যাট শো-ও করেননি!
উইলিয়ামের বল ডিপ কাভারে পাঠিয়ে তিন অঙ্কের কোটায় পৌঁছে তামিম যেন দুই রান নিয়ে সেঞ্চুরি পূরণ করেন। অনেক কষ্টে হাতের ব্যাটটি বুক পর্যন্ত তুলে ধরেন। তারপর নন-স্ট্রাইকিং প্রান্তের ব্যাটসম্যান মাহমুদুল্লাহর সঙ্গে বুক মেলান। তবে সেঞ্চুরির পর তামিম যেন বারুদ হয়ে যান! জিম্বাবুয়ের বোলারদের নাকাল করে একের পর এক বাউন্ডারি হাঁকাতে থাকেন। সেঞ্চুরির পর মাত্র ৩০ বল থেকে ৫৮ রান করেছেন তিনি।
সেঞ্চুরি করার আগেই তামিম কাল আরেকটি মাইলফলক স্পর্শ করেন। প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি ওয়ানডেতে ৭ হাজার রান করেন। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে ৪২তম ব্যাটসম্যান হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন করেন। কাল তামিম যখন বাইশগজে ব্যাট হাতে নামের তখন এই রেকর্ড থেকে ৮৪ রান দূরে ছিলেন। মাইলফলক স্পর্শ করেন জিম্বাবুয়ের বোলার তিরিপানোর বল থার্ডম্যান দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে।
মহাকাব্যিক এই ইনিংসের পর ড্রেসিংরুমে ফিরে নিশ্চয়ই সবার আগে নাজমুল হোসেন শান্তর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন! কেন না শান্ত আত্মত্যাগ না করলে যে হাফ সেঞ্চুরির আগেই ফিরে যেতে হতো তাকে। যেখানে তামিমের রান আউট হওয়ার কথা সেখানে নিজের উইকেট উৎসর্গ করে ড্যাসিং ওপেনারকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন শান্ত! আর ১৫৮ রানের ইনিংস খেলে সতীর্থের উপহারের যথার্থ মর্যাদাই দিয়েছেন তামিম!
বাংলাদেশ : ৩২২/৮ (৫০ ওভার) (তামিম ১৫৮, মুশফিক ৫৫, মাহমুদুল্লাহ ৪১; তিরিপানো ২/৫৫, মুম্বা ২/৬৪)।
জিম্বাবুয়ে : ৩১৮/৮ (৫০ ওভার) (সিকান্দার রাজা ৬৬, তিরিপানো ৫৫*, মাধিভিরে ৫২; তাইজুল ৩/৫২
মেহেদী ১/২৫, মাশরাফি ১/৫২)।
ফল : বাংলাদেশ ৪ রানে জয়ী। ম্যাচসেরা : তামিম।