শনিবার, ১৭ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

আফগানদের বাংলা শিক্ষার দিন

মেজবাহ্-উল-হক

আফগানদের বাংলা শিক্ষার দিন

ছবি : রোহেত রাজীব

মিরপুর যেন জলন্ত উনুন। তাপমাত্রা ৩৭-৩৮ ডিগ্রি হলেও তা শরীরে অনুভূত হচ্ছে ৪৫-৪৬ ডিগ্রি। দুই দশকের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে উষ্ণ মে মাস এটি। এমন তীব্র গরমে যেখানে কয়েক মিনিট রোদে দাঁড়িয়ে থাকাই কঠিন, সেখানে টানা তিন দিন রোদে পুড়ে (মাঝে ৩৯ ওভার ছাড়া) ফিল্ডিং করতে হলো আফগানিস্তানের ক্রিকেটারদের। রোদে পুড়ে পুড়ে অসহায়ের মতো তাকিয়ে দেখতে হলো প্রতিপক্ষের রান উৎসব। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন আগুনে আবহাওয়ায় কোনো দলকে দীর্ঘ সময় ফিল্ডিং করতে হয়েছে কি না!  ছয় বছরে মাত্র ছয় টেস্ট খেলা আফগানদের সপ্তম টেস্টে এসে মিরপুরে এক ‘নির্মম’ অভিজ্ঞতা হলো।

প্রথম ইনিংসে যে দলটি মাত্র ১৪৬ রানে অলআউট হলো সেই দলটিকে বাংলাদেশ টার্গেট দিল ৬৬২ রান। গতকাল আফগানদের শরীরী ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছিল চরম বিরক্তি। মাঠে গরমে হাঁসফাঁস করেছিলেন ফিল্ডাররা, বোলাররাও উইকেট নিতে পারছিলেন না। আফগানরা যেন তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছিলেন কখন বাংলাদেশ দল ইনিংস ঘোষণা করবে। ফিল্ডারদের অভিব্যক্তি ছিল অনেকটা এমন ‘জয় পরাজয় যাই হোক, আগে এ জ্বলন্ত উনুন থেকে মুক্তি মিলুক!’

প্রতিপক্ষকে ভোগান্তিতে রাখা একটা চ্যালেঞ্জও। আর সে কাজটি কাল খুব ভালোভাবেই করতে পেরেছে বাংলাদেশ দল। আগের দিনের ৩৭০ রানের লিডকে এক সময় বাংলাদেশ ৫০০-তে নিয়ে গেল। ৬০০ পার হলো, তবুও ইনিংস ঘোষণা করছে না টাইগাররা। গরমে অতিষ্ঠ আফগানদের বিরুক্তি যেন চরমে পৌঁছে গেল। অবশেষে শেষ বিকালে যখন সূর্যের তেজ কমে গেল। তখন আফগানদের ৬৬২ রানের টার্গেট দিয়েই ইনিংস ঘোষণা করে বাংলাদেশ। টেস্টের ইতিহাসে প্রতিপক্ষকে দেওয়া টাইগারদের রেকর্ড টার্গেট এটি। এর আগে জিম্বাবুয়েকে ৪৭৬ রানের টার্গেট ছিল সর্বোচ্চ।

প্রথম ইনিংসের মতো এ ইনিংসেও দুর্দান্ত নাজমুল হোসেন শান্ত। তুলে নিলেন ‘ব্যাক টু ব্যাক’ সেঞ্চুরি। ১৪৬ রানের ক্যারিশমেটিক ইনিংসের পর গতকাল আবারও ১২৪! কী দারুণ ধারাবাহিকতা। মুমিনুল হকের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে এক টেস্টে দুই সেঞ্চুরি করার নতুন ইতিহাস গড়লেন তিনি।

শান্তর এমন কীর্তি গড়ার দিনে রানের খড়া কাটালেন মুমিনুল হকও। দুই বছর পর পেলেন সেঞ্চুরির দেখা। ১১তম সেঞ্চুরির পর যেন আটকে গিয়েছিলেন। অবশেষে ২৬তম ইনিংসের পর ১২তম সেঞ্চুরি পেয়ে মুমিনুলের স্বস্তি। শেষ পর্যন্ত  তিনি অপরাজিত ছিলেন ১২১ রানে।  প্রথম ইনিংস ব্যাট হাতে ব্যর্থ হলেও এ ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন ক্যাপ্টেন লিটন ও ওপেনার জাকির হাসান। শতক পূর্ণ করার দারুণ সুযোগ ছিল জাকিরের সামনে। কিন্তু রান আউটের ফাঁদে পড়ে পারলেন না। আর ক্যাপ্টেন লিটন ৬৬ রানে অপরাজিত থাকার সময়ই ইনিংস ঘোষণা করেন। ৬৬১ রানের লিড, হাতে অফুরন্ত সময়। অলৌকিক কোনো ঘটনা না ঘটলে এ ম্যাচে টাইগারদের বিশাল জয় কেবলই সময়ের ব্যাপার।

বাংলাদেশের রান উৎসবের দিনে ভিন্ন চিত্র আফগান শিবিরে। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত আফগানিস্তান দলের ব্যাটাররা কাল শেষ বিকালে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশের পেসারদের তোপের মুখে পড়েন। ইনিংসের প্রথম বলেই ক্যারিশম্যাটিক এক ডেলিভারিতে আফগান ওপেনার ইব্রাহিম জাদরানকে লেগ-বিফোরের ফাঁদে ফেলে দেন পেসার শরিফুল ইসলাম। দ্বিতীয় ওভারে আরেক প্রান্ত থেকে তাসকিন এসে গতির ঝড় তুলে আরেক ওপেনার আবদুল মালিককে বোকা বানিয়ে ফেলেন। দুই ওভারে দুই উইকেট নেই আফগানদের। এরপর নিজের তৃতীয় ওভারে তাসকিনের আরেক বিস্ফোরক বাউন্সারে আফগান দলপতি হাশমতউল্লাহ শহীদি ‘চিৎপটাং’! বাধ্য হয়েই রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে বাইরে যেতে হয়।

৬৬২ রানের টার্গেটে পৌঁছা তো এমনিতেই অসম্ভব! এই ম্যাচ বাঁচাতে হলেও তাদের টিকে থাকতে হবে ২২০ ওভার। সেটিও প্রায় অসম্ভব। কী এক কঠিন পরিস্থিতি! তবে এমন পরিস্থিতিকে শিক্ষার অংশ বললেন আফগান কোচ জোনাথন ট্রট, ‘আমি মনে করি টেস্ট ক্রিকেটে আমার ছেলেদের শেখার জন্য একটা ভালো অভিজ্ঞতা, যে এভাবেও দিন পার করতে হয়। টেস্ট ক্রিকেট যে কতটা কঠিন এবং প্রতিপক্ষ অনেক ভালো করলে কেমন লাগে এখান থেকে শিখতে হবে।’

এটি আসলে আফগানদের বাংলা শিক্ষার দিন।

সর্বশেষ খবর