জাতীয় দলের মান যাই থাকুক। ঢাকার ঘরোয়া ফুটবলের জনপ্রিয়তাই ছিল আলাদা। বিভিন্ন ক্লাবে খেলা বিদেশি ফুটবলাররাও স্বীকার করে গেছেন তাদের দেশে ঘরোয়া আসরে গ্যালারিতে এত দর্শক বা জনপ্রিয়তা নেই। পাকিস্তান আমলে ঢাকা প্রথম বিভাগ লিগের এতটা কদর ছিল যে, পশ্চিম পাকিস্তানের ফুটবলাররা খেলতে ঢাকা উড়ে আসতেন। জব্বার, মওলা বক্স, গফুর বেলুচ, ওমর, আবিদ, মুসা, তোয়াব আলী, আইয়ুবদার, কালাগফুর, আলি নেওয়াজরা ঢাকাতে খেলেই তারকার খ্যাতি পেয়েছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ফুটবলে অর্থ ও মান ছিল না বলে তারা ঢাকাকেই বেছে নিয়েছিলেন। গফুর বেলুচ তো ঢাকার ফুটবলের প্রেমের টানে চির কুমার থেকে যান। দেশ স্বাধীন হলেও তিনি আর বেলুচিস্তানে ফিরে যাননি। ফুটবল ক্যারিয়ারে ইতি টানলেও বিজেএমসি ও ব্রাদার্স ইউনিয়নের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকাতেই তাঁর মৃত্যু হয়।
১৯৪৮ সাল থেকে ঘরোয়া ফুটবল শুরুর পর ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারার্স ও মোহামেডানের দাপট ছিল তুঙ্গে। বিশেষ করে মোহামেডান আর ওয়ান্ডারার্সের সমর্থকদের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়। দুদলের প্রতিপক্ষ যেই হোক ম্যাচ দেখতে গ্যালারি ভরে যেত। ষাট দশকের শেষের দিকে অফিস দল ইপিআইডিসির আগমনে তাদেরও আলাদাভাবে সমর্থকের দেখা মিলে।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2024/05.%20May/20-05-2024/20-05-2024-p10-6.jpg)
দেরিতে হলেও বাংলাদেশে পেশাদার ফুটবলে যাত্রা হয় ২০০৭ সালে। শেখ জামাল ধানমন্ডি তিন এবং শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র পেশাদার লিগে একবার চ্যাম্পিয়ন হলেও ঢাকার আবাহনীরই ছিল একক আধিপত্য। কারণ পেশাদার ফুটবলে যাত্রার পর তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান নানা সংকটে বন্দি। ১৯৪৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত লিগে সর্বোচ্চ ১৯ বার চ্যাম্পিয়ন হলেও পেশাদার লিগে একবারও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি দলটি। ছয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়ে ঢাকা আবাহনী এমন অবস্থা সৃষ্টি করে যে, অনেকে ধরে নিয়েছিলেন তাদের সামনে আর কোনো ক্লাব দাঁড়াতেই পারবে না। মোহামেডান যখন লাইফ সাপোর্টে তখন ফুটবলে আবাহনীকে আর থামাবে কে?
সব ভাবনা বদলে যায় বসুন্ধরা কিংসের আবির্ভাবের পরই। পাইনিওয়ার লিগ থেকে বসুন্ধরা গ্রুপের নিজস্ব ক্লাব বসুন্ধরা কিংসের ফুটবলে যাত্রা। এরপর পেশাদারিত্বের সবশর্ত পূরণ করে ২০১৭-১৮ মৌসুমে পেশাদার ফুটবলে দ্বিতীয় স্তরের লিগ বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্সশিপে জায়গা করে নেয়। সেবারই চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশে প্রিমিয়ার লিগে উঠে যায় কিংস। ২০১৮-১৯ মৌসুমে ঘরোয়া ফুটবলে সেরা আসর পেশাদার লিগে অভিষেক হয় বসুন্ধরা কিংসের। বসুন্ধরা গ্রুপের লক্ষ্য ছিল এমন একটা দল গড়বে যেখানে সাফল্যের পাশাপাশি দেশের ফুটবল নতুনভাবে জাগাতে কাজ করবে। কিন্তু অভিষেকের পর থেকে বসুন্ধরা কিংস একের পর এক ইতিহাস লিখে চলবে কেউ কি ধারণা করেছিলেন? কেননা শুধু কিংস নয়, সমমানের শক্তিশালী দল গড়ছে ঢাকা আবাহনীও। শেখ জামাল ধানমন্ডি ও শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র বসুন্ধরা গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত দল। স্বাভাবিকভাবে তারাও শক্তিশালী দল গড়ছে। সাইফ স্পোর্টিংও কোনো অংশে কম ছিল না। এরপরও ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া ঘরোয়া ফুটবলে প্রায় সব রেকর্ড ভেঙে চলেছে কিংস।
বসুন্ধরা কিংস কোন রেকর্ড ভাঙেনি এটাই এখন বড় প্রশ্ন। একটা আক্ষেপ থাকতেই পারে তাদের। এমন অভাবনীয় সাফল্যের পরও লিগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। কিন্তু যে দল পেশাদার লিগে অভিষেকের পর টানা পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সেখানে আক্ষেপ বলে কিছু কি থাকতে পারে? এ রেকর্ড বাংলাদেশ কেন বিশ্বে কোন ক্লাব গড়েছে তা খুঁজতে হিমশিম খেতেই হবে। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক বিখ্যাত ক্লাব আছে। বিশেষ করে ভারতের ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ও মোহামেডান অসংখ্যবার লিগ জিতেছে। কেউ তো আর অভিষেকের পর টানা পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। তাই তো স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু বলেছেন, ‘লিগে বসুন্ধরার একেকটা শিরোপা যেন আকাশের তারা হয়ে ফুটেছে। যাকে বলে পাঁচ তারা বসুন্ধরা।’
ইতিহাস বা রেকর্ড শুধু লিগেই থেমে থাকেনি। মূল পেশাদার ফুটবলে আবির্ভাবের পর পাঁচ বছর পার না করেই ১০ শিরোপার রেকর্ড গড়েছে কিংস। স্বাধীনতা কাপ তিন এবং ফেডারেশন কাপে দুবার চ্যাম্পিয়ন। বুধবার ফেডরেশন কাপ জিতলে ট্রেবলও জিতে নেবে কিংস। বসুন্ধরা কিংস অ্যারিনায় লিগে চ্যাম্পিয়নের ট্রফি বিতরণের পর ক্লাব সভাপতি ইমরুল হাসান বলেছেন, ‘আসছে মৌসুমে তারা আরও শক্তিশালী দল গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছে।’ প্রশ্ন এখন একটাই পাঁচ তারার পর বসুন্ধরা আকাশে কত তারার দেখা মিলবে? দেশের ফুটবলে যত প্রশংসা ও আলোচনা এখন ফুটবল কিং বসুন্ধরা কিংস ঘিরেই।