রবিবার, ১২ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

যেভাবে দিয়াশলাই আবিষ্কার

টেকনোলজি ডেস্ক

যেভাবে দিয়াশলাই আবিষ্কার

পাথরের সঙ্গে পাথর ঘষে এক সময় আদিম যুগের মানুষ আগুন জ্বালাত। সে ৬০০ বছর আগের কথা। তখন আগুন জ্বালানো ছিল খুব শ্রমসাধ্য কাজ। ওই সময় আগুন নিয়ন্ত্রণ কিংবা সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, এ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ১৮৬ বছর আগে আজকের আধুনিক বিশ্বের জন্য যে মানুষটি আগুনকে বাক্সবন্দি করার কথা ভেবেছিলেন তার কথা আমরা কি জানি?

সেই মহামানবের নাম জন ওয়াকার। ইংল্যান্ডের একটি গ্রাম, স্টকটন-অন-টিজ-এ ১৭৮১ সালের ২৯ মে জন ওয়াকার জন্মগ্রহণ করেন। ১০৪ নম্বর হাইস্ট্রিটে ছিল তাদের বাড়ি। এখানেই জন তার বাকি তিন ভাই ও দুই বোনের সঙ্গে বেড়ে ীঠেন। ১৮১৯ সালে ৫৬ নম্বর হাইস্ট্রিট, স্টকটনে জন একটি কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্টের দোকান খোলেন। যার পেছনে তার একটি পরীক্ষাগারও ছিল। আর এখান থেকেই তিনি আবিষ্কার করেন আজকের দিয়াশলাই বা ম্যাচবাক্স। ঘটনাটি ছিল এরকম-জন ওয়াকার একদিন তার পরীক্ষাগারে কাজ করছিলেন। হঠাৎ কিছু রাসায়নিক দ্রব্য যা ছিল অ্যান্টিমনি সালফাইড, পটাসিয়াম ক্লোরাইড, আঠা ও মাড়ের সংমিশ্রণ। সেই সংমিশ্রণের খানিকটা প্রলেপ তার টেবিলের ওপরে থাকা একটি কাঠির চলার ওপর পড়ে যায়। যা জন খেয়াল করেননি। পরে জনের হাতেই সেই কাঠিটি একটা কিছুর সঙ্গে ঘষা খেয়ে আগুন জ্বলে ওঠে। যা জন ওয়াকার বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। ১৮২৬ সালে এভাবেই দুর্ঘটনাবশত জন আবিষ্কার করেন পৃথিবীর প্রথম ঘর্ষণ পদ্ধতির দিয়াশলাই। বিষয়টি জনকে ভীষণ বিচলিত করে তোলে এবং তিনি ভাবতে থাকেন কীভাবে তার এই আবিষ্কার বাণিজ্যিকভাবে বিপণন করা যায়। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া তখনো পৃথিবীতে আসেনি। তাই প্রথম অবস্থায় জন ওয়াকার সরু লম্বা টিনের কৌটায় দিয়াশলাই তৈরি শুরু করেন। প্রতিটি কৌটায় থাকত ১০০ কাঠি। সে সব কাঠির মাথায় থাকত রাসায়নিক প্রলেপ আর সঙ্গে থাকত আগুন জ্বালানোর জন্য এক টুকরা স্যান্ড পেপার। এ সরু টিনের কৌটাগুলোকে দেখলে ঠিক বোঝা যেত না যে, এগুলো ম্যাচবক্স। কারণ এর গায়ে কোনো লেভেল ছিল না। লেভেল না থাকলেও এ টিনের কৌটার ম্যাচগুলো ‘ওয়াকার্স ফ্রিকশন ম্যাচ’ নামে পরিচিত এবং জনপ্রিয় ছিল। জন ওয়াকার তার ব্যবসায়িক হিসাবপত্র রাখতেন একটি ডায়েরিতে। যে ডায়েরিটি সংরক্ষিত আছে লন্ডনের সায়েন্স মিউজিয়ামে। ওই ডায়েরিতে তারই লেখা একটি তথ্য থেকে জানা যায়, জন ওয়াকার তার প্রথম টিন ম্যাটটি বিক্রি করেন ৭ এপ্রিল ১৮২৭ সালে জনৈক ব্যারিস্টার মি. হিক্সনের কাছে এক শিলিংয়ের বিনিময়ে। যিনি ছিলেন স্টকটনের বাসিন্দা। প্রযুক্তিগত কারণে কিছুটা হলেও জন ওয়াকারকে বেগ পেতে হয়েছিল, কিন্তু ম্যাচের নিরাপদ মোড়ক খুব জরুরি হয়ে ওঠে। জন ম্যাচগুলোকে হার্ডবোর্ডের বাক্সে প্যাকেটজাত শুরু করেন যাতে ঘর্ষণের জন্য লাগিয়ে দেওয়া হতো স্যান্ড পেপারের টুকরো। জন ওয়াকারের এটি ছিল এক যুগান্তকারী আবিষ্কার যা রাতারাতি বদলে দেয় মানুষের জীবনধারা। ১৮৪০ সালের মধ্যে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে ম্যাচবক্সের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। যা জন ওয়াকারের আবিষ্কৃত পদ্ধতিতেই তৈরি হতো। কিন্তু ততদিনে ইংল্যান্ডে আরও অনেকেই ম্যাচ ফ্যাক্টরি তৈরি করেন। ওই সময় ম্যাচ তৈরি হতো সাদা ফসফরাসের মাধ্যমে। ফসফরাস হলো এমন একটি রাসায়নিক দ্রব্য যা ম্যাচের কাঠির মাথায় লাগানো হতো। ফসফরাসের একটি মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল। যা মূলত তখনকার ম্যাচ কারখানা শ্রমিকদের চোয়ালের হাড্ডিতে মারাত্মক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ রোগের কারণে অনেক শ্রমিকের মৃত্যুও হয়েছে। ১৮৮৬ সালে ম্যাচ কারখানাগুলোতে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, ন্যায্য মজুরি ও অন্যান্য দাবি-দাওয়া নিয়ে একটি নারী জাগরণ হয়। ১৯১১ সাল পর্যন্ত ম্যাচ ফ্যাক্টরিগুলোর অবস্থা একই রকম ছিল। একই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডায়মন্ড ম্যাচ কোম্পানি ‘নন টক্সিন’ বা ক্ষতিকারক দ্রব্যহীন ম্যাচ বা নিরাপদ দিয়াশলাই উৎপাদন শুরু করে ক্রেতাদের জন্য। যার ফলশ্র“তিতে ডায়মন্ড ম্যাচ কোম্পানিকে ভূষিত করা হয় ‘লুইস লিভিংস্টোন সিম্যান’ পদকে। অবসান হয় ফসফরাসের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং সূচনা হয় ম্যাচ শিল্পের নতুন অধ্যায়।

পৃথিবীজুড়ে রয়েছে অনেক দিয়াশলাই তৈরির কারখানা। যারা একটি দিয়াশলাইকে দিয়েছে আধুনিক রূপ। দিয়েছে নানা রং, মাপ আর নকশা। এটি এখন আর শুধু একটি ম্যাচবাক্সই নয়, এটি একটি শিল্পকর্ম। যে শিল্পকর্মের মূল স্রষ্টা জন ওয়াকার। যাকে ছাড়া দিয়াশলাইয়ের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়। ১৮৫৯ সালে ৭৮ বছর বয়সে চিরকুমার জন ওয়াকার মৃত্যুবরণ করেন।

সর্বশেষ খবর