একসময় মহাবিশ্বে তারকার চারপাশে গ্রহ খুঁজে পাওয়া ছিল কঠিন কাজ। আর বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোল (কৃষ্ণগহ্বর) এবং দূরবর্তী গ্যালাক্সি (ছায়াপথ) আবিষ্কার করলেও, আমাদের সৌরজগত মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বাইরে প্রথম গ্রহের সন্ধান পাওয়া যায় আরও অনেক পরে। ১৯৯২ সালে প্রথম সৌরজগতের বাইরের গ্রহ-নক্ষত্র (এক্সোপ্ল্যানেট) আবিষ্কৃত হয়। আজকের বিশ্বে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পাঁচ হাজারের বেশি দূরবর্তী গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন। কিন্তু আমরা এখনো এসব দূরবর্তী গ্রহ সম্পর্কে খুব কম জানি। অসংখ্য চিত্রে এগুলোকে রঙিন আগ্নেয়গিরি, মহাসাগর ও মেঘাচ্ছন্ন আকাশসহ দেখানো হয়। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন যে, বহির্বিশ্বের গ্রহ-নক্ষত্রগুলো সত্যিই এমন কি না! কারণ, তারা সাধারণত সেসবের ভর, আকার এবং নক্ষত্র থেকে দূরত্বের ওপর ভিত্তি করে আনুমানিক ধারণা দিয়ে থাকেন।
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা- নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) এখন এসব দূরবর্তী গ্রহগুলো (এক্সোপ্ল্যানেট) সম্পর্কে নতুন নতুন চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশ করছে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি) দূরবর্তী সৌরজগত থেকে আলো সংগ্রহ করে এবং বিভিন্ন গ্রহের বায়ুমণ্ডলে থাকা নির্দিষ্ট গ্যাস শনাক্ত করতে পারে। এর মধ্যে জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন এবং অন্যান্য অণু অন্তর্ভুক্ত। ২০২১ সালে উৎক্ষেপণের পর থেকে এই টেলিস্কোপ শত শত এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণ করেছে। তবে বিজ্ঞানীদের লক্ষ্যবস্তু হলো- বৃহৎ গ্যাসীয় গ্রহ থেকে শুরু করে পৃথিবীর মতো গ্রহ। জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর অ্যাস্ট্রোনমির জ্যোতির্বিজ্ঞানী লরা ক্রেইডবার্গ বলেন, বহির্বিশ্বে প্রাণের সন্ধান পাওয়ার ব্যাপারে আমরা অনেক আশাবাদী। এই টেলিস্কোপ একদিন ভিনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব শনাক্ত করতে পারবে। তিনি আরও বলেন, ‘বিজ্ঞানীদের এখনো গ্রহ সম্পর্কে অনেক কিছু শেখার আছে- জানার আছে, যাতে তারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভিনগ্রহে প্রাণের শনাক্ত করতে পারেন। জেডব্লিউএসটি সে ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের পরিধি খুবই ক্ষীণ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে আমাদের জানা বেশির ভাগ গ্রহের তথ্য পেয়েছি আমাদের সৌরজগত তথা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির আটটি গ্রহ থেকে। তবে পরবর্তী দশকে, টেলিস্কোপ প্রযুক্তি (হাবল স্পেস টেলিস্কো এবং জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ) পুরো গ্যালাক্সিজুড়ে বিভিন্ন ধরনের গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহ করে পৃথিবীতে পাঠায়। আর সেসব তথ্য থেকে আমরা পৃথিবীবাসী জানতে পারি অজানা এবং রহস্যময় মহাবিশ্ব সম্পর্কে। তন্মধ্যে কিছু গ্রহ- শিলাময় অর্থাৎ পৃথিবীর মতো পাহাড়-পাথুরে-মাটির, আবার কিছু গ্যাসীয়, লাভাময় গ্রহ বা সম্পূর্ণ জলের। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাবিশ্বে এমন গ্রহের অস্তিত্ব থাকতে পারে- যা আমাদের সৌরজগতে নেই। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ নতুন আবিষ্কৃত এক্সোপ্ল্যানেটগুলোর গঠন ও উৎপত্তি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে। এটি আমাদের সৌরজগতের বাইরের জগৎ কতটা সাধারণ বা ব্যতিক্রমী সেটিও নির্ধারণ করতে সহায়তা করতে পারে।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) গ্রহের যেসব- রহস্য উন্মোচন করতে পারে
♦ এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ : বহির্বিশ্বের কোনো গ্রহ (এক্সোপ্ল্যানেট) যখন তার নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে, তখন এটি পৃথিবী ও নক্ষত্রের মাঝখানে চলে আসে (যাকে ট্রানজিট বলা হয়)। এই সময় নক্ষত্রের আলো গ্রহের বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে পৌঁছায়। বিজ্ঞানীদের ভাষ্য, বিভিন্ন গ্যাস বিভিন্ন ধরনের আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যকে শোষণ করতে পারে। ফলে বিজ্ঞানীরা নির্ণয় করতে পারেন যে, এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডলে মূলত কী কী ধরনের গ্যাসের অস্তিত্ব রয়েছে। কারণ কিছু নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্য পৃথিবীতে পৌঁছায় না। অনেক গ্যাস যেমন- জলীয় বাষ্প ও CO2, ইনফ্রারেড আলো শোষণ করে। আর JWST ইনফ্রারেড আলো শনাক্ত করতে পারদর্শী। ফলে এটি বিভিন্ন এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প, কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। JWST-এর এসব পর্যবেক্ষণ আমাদের জানাতে পারে, এক্সোপ্ল্যানেটগুলোর বায়ুুমণ্ডল কেমন, তারা কীভাবে তৈরি হয় এবং এগুলোতে প্রাণের অনুকূল পরিবেশ ধারণ করতে পারে কি না।
♦ মহাবিশ্বের কোন কোন শিলাময় এক্সোপ্ল্যানেটের বায়ুমণ্ডল রয়েছে?
শিলাময় গ্রহ- যেমন : পৃথিবী। আর এটি ভিনগ্রহের প্রাণের সন্ধানের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। কিন্তু যদি কোনো শিলাময় গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব থাকে! তাহলে তার একটি বায়ুমণ্ডলও থাকা জরুরি। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন কী কারণে বা কোনো শিলাময় গ্রহ বায়ুমণ্ডল ধরে রাখতে পারে, আর কোনোটি পারে না। আমাদের সৌরজগতে, বায়ুমণ্ডল থাকা কিংবা না থাকা গ্রহগুলোর মধ্যে এক সুস্পষ্ট বিভাজন রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এই বিভাজনরেখাকে ‘কসমিক শোরলাইন’ (Cosmic Shoreline) বা ‘মহাজাগতিক তটরেখা’ বলে থাকেন। এই রেখার এক পাশে রয়েছে সেই গ্রহগুলো, যেগুলো সূর্য থেকে প্রচণ্ড বিকিরণ (radiation) গ্রহণ করে এবং যেগুলোর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যথেষ্ট নয়। ফলে তারা তাদের বায়ুমণ্ডল ধরে রাখতে পারে না।
[ বাকিটা পরবর্তীতে... ]