সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়ে মতানৈক্য

সোহেল সানি

মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়ে মতানৈক্য

‘হাউ ইজ শেখ মুজিব, ইজ হি অল রাইট?’

উপর্যুক্ত প্রশ্নটা করেছিলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-বাংলাদশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পরিচয়দানকারী তাজউদ্দীন আহমদকে। প্রতিউত্তরে ইন্দিরা গান্ধীকে তাজউদ্দীন আহমদ ইংরেজিতে যা বলেছিলেন, তার বঙ্গানুবাদ হলো- ‘২৫ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর অদৃশ্য স্থান থেকে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। শুরু হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী আমি। যে কোনো মূল্যে আমাদের বিজয়ী হতে হবে। আমাদের অস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্য দরকার। ভারতের গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহায়তা চাই।’

৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ দ্বিতীয় বারের মতো ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। ইন্দিরা গান্ধীর কাছেই তাজউদ্দীন শুনতে পান যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভারত প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারতের মাটিতে অবস্থান করতে পারবে। যাবতীয় সহায়তা দেওয়া হবে।’ ইন্দিরা গান্ধী এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল নগেন্দ্র সিংকে দায়িত্ব দেন এবং একটি ছোট বিমানও দেওয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতায় আসেন। গাজা পার্কের কাছে একটা বাড়িতে ছিলেন এএইচএম কামরুজ্জামান ও এম মনসুর আলী। সেখানে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদও অবস্থান করছিলেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম স্মৃতিচারণ করে বলেন, সেদিন আমাকে একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে শেখ ফজলুল হক মনি বলেন, সরকার গঠনের প্রশ্নে পরিষদ সদস্যরা খুশি নন। তারা প্রিন্সেস স্ট্রিটের এমএলএ হোস্টেলে আছেন। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বুঝতে পারলাম। কামারুজ্জামানকে নিয়ে পরিষদ সদস্যরা একটি বৈঠকও করলেন। মিজানুর রহমান চৌধুরীও দ্বন্দ্বে ছিলেন। রাতের বেলা লর্ড সিনহা রোডে বৈঠক বসল। শেখ মনি তাঁর বক্তৃতায় বললেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শত্রু শিবিরে বন্দি, বাংলার যুবকরা বুকের তাজা রক্ত দিচ্ছে। এখন কোনো মন্ত্রিসভা গঠন করা চলবে না। মন্ত্রী মন্ত্রী খেলা এখন সাজে না। এখন যুদ্ধের সময় সবাইকে রণক্ষেত্রে যেতে হবে। রণক্ষেত্রে গড়ে উঠবে আসল নেতৃত্ব। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করতে হবে। বৈঠকে প্রায় সবারই একই সুর। তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয়দান ছিল সত্যিই বিস্ময়কর ঘটনা। কারণ তাজউদ্দীন আহমদ নিজেকে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে প্রধানমন্ত্রী পরিচয় দেন ২ এপ্রিল ও দ্বিতীয় বার ৪ এপ্রিল ১৯৭১। সরকার গঠন হয় ১০ এপ্রিল আর শপথগ্রহণ ১৭ এপ্রিল। তাহলে প্রধানমন্ত্রী হলেন কী করে? কূটনীতির কুটকৌশল থাকতে পারে। তাই হয়তো শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মনে নেতিবাচক প্রশ্নের উদ্রেক করেনি কিন্তু দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরে সহচরের তোপের মুখে পড়তে হয় তাজউদ্দীন আহমদকে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গঠিত ছয় সদস্যবিশিষ্ট আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে।

যা হোক প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ অস্থায়ী সরকারের স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। এএইচএম কামারুজ্জামান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁকে হাইকমান্ডের সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ কথা বলে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘প্রাদেশিক পরিষদের নেতা হিসেবে এম মনসুর আলী হবেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে প্রধানমন্ত্রী হবেন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আপনি। পদপদবি নিয়ে সৃষ্ট অন্তঃকলহ উত্তাপ ছড়িয়ে দিল-৮ এপ্রিল কলকাতার ভবানীপুরের রাজেন্দ্র রোডের বাড়িতে। ওখানে উপস্থিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা। অধিকাংশই তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রীর পদগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং পরিস্থিতি সরগরম করে তোলেন। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী ও যুবনেতাদের পক্ষে শেখ ফজলুল হক মণি বিতর্কের অবতারণা করেন। তবে এ বিতর্কের অবসান ঘটে।  এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের উদারতায়। তারা ঐক্যের স্বার্থে তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর