মঙ্গলবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বেপরোয়া কিশোর লেগুনা চালক

বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা

মানিক মুনতাসির

ঘটনা-১ : ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাড়ে ৯টা। স্থান খিলগাঁও রেলগেট। বাসাবো থেকে দ্রুতবেগে একটি লেগুনা এসে খিলগাঁও রেলগেটে একটি রিকশাকে ধাক্কা দিল। রিকশায় কোনো যাত্রী না থাকায় তেমন বিপদ হয়নি। তবে রিকশাচালক নিচে নেমে লেগুনার ভিতর থেকে খুব সহজেই টেনে নামালেন চালককে। এরই মধ্যে দু-তিনটা থাপ্পড়ও দিয়ে দিলেন রিকশাচালক। কিশোর লেগুনা চালকের চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে হলো বয়স ১৫ থেকে ১৬ বছর। গোঁফ উঠেনি ঠিকমতো। কিন্তু গলায় অনেক জোর। কচি কণ্ঠের চিৎকারে ছুটে আসে আরেকজন। সে তো কিশোর নয়। শিশু বলাই ভালো। নাম কী জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে মুখে খই ফুটল। আমার নাম সুমন। বসয় ১২ বছর। বাবা নাই। মা আছে। স্কুলে যাই না। আর কিছু বলবেন। বলেই ছুটল লেগুনার পিছু পিছু।

ঘটনা-২ : স্থান ফার্মগেট। দুপুর আড়াইটা। গন্তব্য নিউমার্কেট। ফার্মগেট থেকে নিউমার্কেটগামী লেগুনায় উঠে ড্রাইভিং সিটে চোখ পড়তেই দেখা গেল ১৫-১৬ বছর বয়সী শ্যামলা বর্ণের একটি কিশোর। এবার লেগুনা ছুটে চলল নিউমার্কেটের উদ্দেশে। কিছুক্ষণ পর ভাড়া চাইল যে ছেলেটি তার বয়সও ১৫-এর নিচে। ইতিমধ্যে লেগুনাটি পৌঁছে গেছে নিউমার্কেট। সেখানে গিয়ে দেখা গেল এক বয়স্ক লোক আর এক কিশোরের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। একটু পর বিষয়টা জানা গেল কিশোর লেগুনা চালক প্রাইভেটকারকে সাইড না দেওয়ায়। ব্যক্তিগত গাড়ির সঙ্গে ঘষা লেগেছে। ফলে দুজনের মধ্যে চলছে বাকবিতণ্ডা। এমন কিশোর-শিশু চালক আর সহকারীরা রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে লেগুনা চালাচ্ছে। রাজধানীজুড়ে এমন কচি হাতে স্টিয়ারিংয়ের শক্ত হ্যান্ডেল জীবনকে নিয়ে যাচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। এসব চালক আর সহকারী প্রায় প্রত্যেকেই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে অপ্রাপ্ত বয়সে। ফলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই গাড়ি চালানোর পাশাপাশি তারা জড়িয়ে পড়ছে আরও নানা ধরনের সামাজিক অপরাধের সঙ্গে। এদের অধিকাংশেরই নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স। আর যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে তার বেশির ভাগই অবৈধ। চালক সমিতিতে এদের কোনো পরিসংখ্যানও নেই। এমনকি লেগুনা মালিক সমিতির কাছেও এদের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। বয়স কম হওয়ায় এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় এসব চালক ও সহকারীরা যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। আবার অনেক সময় তুচ্ছ কারণে যাত্রীদের দ্বারা এসব চালক ও সহকারীরা প্রহারের শিকার হচ্ছে।

গুলশান, মহাখালী, বাড্ডা, খিলগাঁও মোহাম্মদপুর, গুলিস্তান, জিগাতলাসহ রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে এসব কম বসয়ী চালক আর সহকারীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লেগুনা নিয়ে। ঘটছে অহরহ দুর্ঘটনা। এসব কম বয়সী লেগুনা চালকরা জানায়, প্রায় সবাই আর্থিক অনটনের কারণে অল্প বয়সেই পরিবারের হাল ধরেছে।  রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী লেগুনা, টেম্পো, হিউম্যান হলারসহ নানা নামে পরিচিত ছোট গাড়ির চালকদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু-কিশোর। তাদের নেই প্রশিক্ষণ বা ড্রাইভিং লাইসেন্স। কিন্তু এদের অবৈধ ড্রাইভিং ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কোনো উদ্যোগ নেয় না। এরাই বড় হয়ে বসে যায় বড় বাস-ট্রাক চালকের আসনে। চালক ও মালিক সমিতির কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীতে প্রায় ১২টি রুটে প্রায় ৮০০ লেগুনা চলাচল করে। এর মধ্যে ফার্মগেট থেকে মোহাম্মদপুর, জিগাতলা ও কৃষি মার্কেট এই তিন রুটে ঢাকা ইন্দিরা পরিবহনের প্রায় দেড়শ লেগুনা চলে। গাবতলী-মহাখালী রুটে ৬০টি, মিরপুর-মহাখালী রুটে ৭০, মোহাম্মদপুর থেকে গুলশান হয়ে বাড্ডা পর্যন্ত ৮০টির মতো লেগুনা চলে। এ ছাড়া নীলক্ষেত থেকে ফার্মগেট, গোড়ান থেকে গুলিস্তান, মিরপুর ১ নম্বর থেকে জিগাতলা, মিরপুর ১০ নম্বর থেকে মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদসহ আরও কয়েকটি পথে লেগুনা চলাচল করে। এসব রুটে চলাচলকারী লেগুনায় সহস্রাধিক চালক এবং সমানসংখ্যক সহকারী কর্মরত রয়েছে।

সর্বশেষ খবর