মঙ্গলবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

গলার কাঁটা বক্স কালভার্ট

জয়শ্রী ভাদুড়ী

গলার কাঁটা বক্স কালভার্ট

রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকার ছবি —জয়ীতা রায়

রাজধানীতে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত বক্স কালভার্ট অপসারণ নিয়ে তৈরি হয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকলেও কালভার্ট অপসারণ না করে ভিতরের বর্জ্য পরিষ্কার করার পরিকল্পনা করছে এ সংক্রান্ত কমিটি। রাজধানীর তিনটি খাল ধ্বংস করে তৈরি ১৫ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজধানীবাসীর গলার কাঁটা। বক্স কালভার্টকে ঢাকার জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে তা খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর এগুলোর ওপর ফ্লাইওভার কিংবা বিকল্প কিছু করা যায় কিনা তা নিয়ে ভাবতে বলেছিলেন তিনি। গত বছরের ৩১ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে তাঁর এমন নির্দেশনা পেয়ে করণীয় নির্ধারণে একটি কমিটি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এই কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, চিহ্নিত বক্স কালভার্টগুলো অপসারণ করা যুক্তিযুক্ত হবে না বলে মনে করছে এ সংক্রান্ত  কমিটি। এগুলো অপসারণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যাও চিহ্নিত করা হয়েছে। একাধিক বৈঠকে আলোচনার পর কমিটি প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বক্স কালভার্টগুলো না খুলে যন্ত্র দিয়ে নিয়মিত এর ভিতরের বর্জ্য পরিষ্কার করা হবে। নতুন করে আর এমন কালভার্ট নির্মাণ না করার পক্ষেও মত কমিটির। এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক পানি বিশেষজ্ঞ মুজিবুর রহমান বলেন, বক্স কালভার্টগুলোর নকশাতেই ত্রুটি আছে। গোলাকার না করে আয়তাকারভাবে বক্স তৈরি করায় ময়লা খুব দ্রুত জমার সুযোগ পায় এগুলোর ভিতরে। সুয়ারেজ লাইন আলাদা না থাকায় বক্স কালভার্টের ভিতরে জমছে কঠিন বর্জ্য, তৈরি হচ্ছে বিষাক্ত গ্যাস। এসব কালভার্ট পরিষ্কার করতে গিয়ে শ্রমিকদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।

তিনি আরও বলেন, ‘দুই মেয়র নির্বাচিত হয়ে নগরভবনে আসার পর বক্স কালভার্ট খুলে দেওয়ার জন্য প্রথমে আমিই বলেছিলাম। এতে খাল ফিরে আসবে, প্রাকৃতিক পরিবেশ বজায় থাকবে। কিন্তু ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন এ সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পায়। এ বিষয়ে কমিটির সদস্য ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মেজবাহুল ইসলাম গত মাসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বক্স কালভার্ট উন্মুক্ত করে দেওয়া সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর আমরা চিন্তাভাবনা করে দেখেছি। এগুলো ভাঙতে গেলে নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে। কারণ, যেসব স্থানে বক্স কালভার্ট রয়েছে, সেখানে এখন রাস্তা। দুই পাশে বহুতল ভবন হয়ে গেছে। এখন রাস্তা তো বন্ধ করে দেওয়া কঠিন। তবে যেসব বক্স কালভার্ট রয়েছে সেগুলো উন্মুক্ত না করে আধুনিক যন্ত্র দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।’ সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থাগুলো মনে করছে, নগরীর বক্স কালভার্টগুলো ‘অকার্যকর’ হয়ে পড়লেও পরিষ্কার করে এগুলো সচল রাখা সম্ভব। এ জন্য তিন সংস্থা তিনটি যন্ত্র সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া বক্স কালভার্টের যেসব স্থানে ত্রুটি রয়েছে সেগুলোর কারিগরি ও নকশাগত পরিবর্তন আনারও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ঢাকার ড্রেন ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কারের জন্য ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ১০ কোটি টাকা ও গত বছরের জুনে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন’ নামে দুটি যন্ত্র কেনে। চার কোটি টাকা ব্যয়ে এস্কেভেটর ও গ্রেভার নামে আরও একটি যন্ত্র কিনেছে ঢাকা ওয়াসা। এই যন্ত্রগুলো দিয়েই বক্স কালভার্ট পরিষ্কার করতে চায় সংস্থাগুলো।

বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় ১৫ কিলোমিটারের মতো বক্স কালভার্ট রয়েছে। এর ৮ কিলোমিটার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। এর মধ্যে রয়েছে রাসেল স্কয়ার থেকে গ্রিন রোড হয়ে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল, হাতিরপুলের মোতালেব প্লাজা থেকে সোনারগাঁও হোটেল, পান্থপথ থেকে পরীবাগ, ইব্রাহিমপুর বাজার থেকে মিরপুর বাউনিয়া খাল, সেগুনবাগিচা থেকে আরামবাগ হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, খিলগাঁও থেকে তিলপাপাড়া পর্যন্তসহ আরও কয়েকটি স্থানে স্বল্পদৈর্ঘ্যের বক্স কালভার্ট সড়ক রয়েছে। রাসেল স্কয়ার থেকে সার্ক ফোয়ারা পর্যন্ত পান্থপথের প্রায় পুরো রাস্তাই পড়েছে বক্স কালভার্টের ওপর। ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত কালভার্টগুলো কমবেশি ভরাট হয়ে যাওয়ায় একদিকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে ভিতরে বিষাক্ত গ্যাস জমে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।

আশির দশকের মাঝামাঝি পরীবাগ খাল ভরাট করে সাড়ে তিন কিলোমিটার বাক্স আকারের ‘বক্স কালভার্ট’ তৈরি করা হয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে সেগুনবাগিচা খালের স্থানে নির্মিত হয় প্রায় সাত কিলোমিটার কালভার্ট। বিগত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে ধোলাইখাল ধ্বংস করে তৈরি করা হয় আরও সাড়ে তিন কিলোমিটার কালভার্ট। এগুলো পরিষ্কার করতে প্রতিবছর প্রায় ছয় কোটি টাকা খরচ হলেও পানি নিঃসরণে রাজধানীবাসী পাচ্ছে না সে সুফল।

 

সর্বশেষ খবর