মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

টার্মিনালে প্রতারক চক্র

আলী আজম ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

টার্মিনালে প্রতারক চক্র

অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি হতে সাবধান থাকার জন্য টার্মিনালগুলোতে পুলিশের সতর্ক বার্তা দেখা যায় তারপরেও টার্মিনালগুলোতে সক্রিয় প্রতারক চক্র ছবিটি মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে তুলেছেন —জয়ীতা রায়

ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার জন্য গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মোক্তার আলী। ইফতারের সময় হয়ে আসায় হকারের কাছ থেকে ছোলা-মুড়ি আর জুস কিনেছিলেন তিনি। খাবার খাওয়ার পরের ঘটনা আর কিছু মনে করতে পারেন না তিনি। মালিবাগ রেল গেটের পাশে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে পাশের হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে যান স্থানীয়রা। জ্ঞান ফিরলে তিনি জানান, তার পকেটে বেশ কিছু টাকা এবং মোবাইল ছিল। সবকিছু কেড়ে নিয়ে তাকে ফেলে দিয়ে গেছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা।

রাজধানীতে ঈদ সামনে রেখে অজ্ঞান-মলম পার্টির তৎপরতা বেড়েছে। বাস-লঞ্চ টার্মিনাল এবং রেল স্টেশনের জনাকীর্ণ স্থানে হকার সেজে বিভিন্ন রকমের খাবার বিক্রি করছে তারা। আর এসব খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে চেতনানাশক ওষুধ। কেউ এসব খাবার খেলেই মাশুল দিতে হচ্ছে তাকে। ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা। একের পর এক তালিকা করেও তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। হাতে গোনা কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও আদালত থেকে জামিন নিয়ে আবার একই কাজে জড়িয়ে পড়ছে তারা। বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশনসহ গুরুত্বপূর্ণ ৪০টি পয়েন্টে অজ্ঞান পার্টির শতাধিক গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সহজ-সরল মানুষকে লক্ষ্য করে ফেরিওয়ালা সেজে জুস, ডাবের পানি, খেজুর, ঝাল মুড়ি, শরবতসহ নানা উপকরণ বিক্রি করছে। আর প্রতারিত মানুষ সর্বস্ব হারানোর পাশাপাশি জীবন হারানোর মতো ঝুঁকিতে পড়ছেন। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে অপরিচিত কারও দেওয়া খাবার না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ডিএমপি ডিসি (মিডিয়া) মো. মাসুদুর রহমান জানান, ঈদকে সামনে রেখে অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যরা তৎপর হয়ে ওঠে। তারা নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে টার্গেট করে। এরপর কৌশলে অজ্ঞান করার ওষুধ মেশানো খাবার খাইয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে ফুটপাথের চা বিক্রেতাসহ ছোট দোকানদাররাও তাদের দলের সদস্য। কৌশলে চা কিংবা অন্য কোনো খাবারের সঙ্গে অচেতন করার ওষুধ মিশিয়ে মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে তারা।

গত শুক্রবার রাজধানীর শনিরআখড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে চেতনা নাশক ওষুধসহ অজ্ঞান পার্টির ১২ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ডিএমপির গোয়েন্দা উত্তর বিভাগ। এ সময় তাদের কাছে চেতনা নাশক ওষুধ এবং এসব ওষুধ মেশানো খেজুর, জুস ও ক্রিম বিস্কুট জব্দ করা হয়। এর আগে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে অভিযান চালিয়ে অজ্ঞান ও মলম পার্টির ১২ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

এ ছাড়া ২৩ মে এই চক্রের আরও ১২ সদস্যকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। ডিবি (পশ্চিম) বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গ্রেফতারকৃতরা ঢাকা-গাজীপুর রোডের বিভিন্ন পরিবহনে উঠে যাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করত। এরপর কৌশলে তাদের চেতনানাশক ট্যাবলেট মেশানো পানীয় পান করাত অথবা কখনো তাদের চোখে বিষাক্ত মলম লাগিয়ে দিত। যাত্রীরা অজ্ঞান হয়ে গেলে সুযোগ বুঝে নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করত। এমনকি তারা বিভিন্ন চায়ের দোকানে সাধারণ মানুষের চায়ের সঙ্গে চেতনানাশক ট্যাবলেট মিশিয়ে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুট করত।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী, সদরঘাট, গুলিস্তানসহ বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড, কমলাপুর রেলস্টেশনে এবং সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যদের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। তারা সাধারণত তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে কাজ করছে। একটি গ্রুপ ফেরি করে খাবার বিক্রি করে। আরেক গ্রুপ উদ্ধারকর্মী হিসেবে আশপাশেই ঘোরাঘুরি করে। তৃতীয় গ্রুপ রিকশা বা সিএনজি নিয়ে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বসে থাকে। টার্গেট ব্যক্তি অচেতন হয়ে পড়লে পরিচিত সহযাত্রী অথবা কাছের আত্মীয় হিসেবে দ্বিতীয় গ্রুপের সদস্যরা এগিয়ে যায়। অচেতন ব্যক্তিকে হাসপাতালে নেওয়ার নাম করে তৃতীয় গ্রুপ নিজেদের যানবাহনে তোলে। এরপর সুযোগ বুঝে টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নিয়ে অচেতন ব্যক্তিকে রাস্তায় ফেলে চলে যায়। রোজার আগে থেকেই এদের অপতৎপরতা রুখতে গোয়েন্দারা অভিযানে নেমেছে। পুরো রমজান মাসজুড়েই অভিযান চলবে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, প্রতি বছর বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে এদের তৎপরতা বেড়ে যায়। অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যদের গ্রেফতারে র‌্যাব নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর