মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

দুর্ঘটনার হটস্পট হানিফ ফ্লাইওভার

শামীম আহমেদ

দুর্ঘটনার হটস্পট হানিফ ফ্লাইওভার

মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দুর্ঘটনার মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। বেপরোয়া গতি এবং ফ্লাইওভারের সংযোগস্থলে প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ছে মোটরসাইকেল। পেছনের দ্রুতগতির যানবাহন চাপা দিয়ে চলে যাচ্ছে ছবি : রোহেত রাজীব

রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারটি দুর্ঘটনার হটস্পট হয়ে উঠেছে। অন্যভাবে বলা যায়, এই ফ্লাইওভার যেন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। গত শুক্রবারও এই ফ্লাইওভারে একটি যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে গিয়ে ছয় যাত্রী আহত হয়েছেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় গুলিস্তান থেকে ডেমরা রোডে চলাচলকারী আসিয়ান পরিবহনের বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফ্লাইওভারের ডিভাইডারে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায়। হানিফ ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর ঘটনা যাত্রাবাড়ী থানায় দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।

যাত্রাবাড়ী, ওয়ারী থানা ও ট্রাফিক পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৬-১৭ সালে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে দুই শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪০ জন, আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক। সম্প্র্রতি শুধু যাত্রাবাড়ী থানার তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ৩৩ জন, ২০২০ সালে ৫৭ জন এবং ২০২১ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত ৩৯ জন যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে, যাদের বড় একটি অংশ বাইকার।

স্থানীয় ও ফ্লাইওভার ব্যবহারকারীরা বলছেন, বেপরোয়া গতির কারণে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের বিভিন্ন অংশে প্রতিদিনই একটা না একটা দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে আহত ও নিহতের সংখ্যা বাড়ছে। এই ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি পড়ছে মোটরসাইকেল আরোহীরা। কখনো বেপরোয়া গতিতে চালানোর কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রেলিংয়ে ধাক্কা দিচ্ছে, কখনো আবার পেছনের বেপরোয়া গতিতে হর্ন দিতে দিতে ছুটে আসা অন্য যানবাহনকে দ্রুত সাইড দিতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ছে।

এ ছাড়া ফ্লাইওভারের একাধিক রুটের সংযোগস্থলগুলোয় বসানো রেললাইনের মতো লোহার পাতের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায়ই মোটরসাইকেল পিছলে পড়ে যাচ্ছে। এতে কখনো আরোহী আহত হচ্ছেন, অনেক সময় পেছনে থাকা দ্রুতগতির যানবাহন চাপা দিয়ে চলে যাচ্ছে। ফ্লাইওভারে উঠলেই সবাই গতির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল চালকরা কে কাকে ওভারটেক করতে পারে সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

এদিকে ২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে কথাকাটাকাটির জেরে গ্রিনলাইন পরিবহনের বাসচালক প্রাইভেটকার চালক রাসেল সরকারের (২৩) ওপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে দেন। এতে রাসেলের দেহ থেকে বাম পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর অস্ত্রোপচার করে তার বাম পা কেটে ফেলা হয়। কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলায় বিষয়টি হাই কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। সেই জের সাড়ে তিন বছর ধরে টেনে চলেছে গ্রিনলাইন পরিবহন। এ পর্যন্ত রাসেল সরকারকে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে তারা। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনা ঘটানো যানবাহনকে শনাক্ত করা ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।

মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে মোটরবাইকে নিয়মিত চলাচলকারী রিয়াজুল ইসলাম বলেন, মূল সড়ক থেকে ফ্লাইওভারে উঠেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে যানবাহনগুলো। ওভারটেকিংয়ের প্রতিযোগিতায় নামে বাসগুলো। ফ্লাইওভারে সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও তা কেউ মানে না। রাতের বেলায় লোকাল বাসগুলোও ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে চলে। ওভারটেকিংয়ের জন্য এমনভাবে হর্ন দেওয়া শুরু করে যে, সামনের ছোট-বড় যানবাহনগুলোর মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। সাইড দেওয়ারও সময় দিতে চায় না বাসগুলো। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ফ্লাইওভারের নিচের সড়কটি চলাচলের উপযোগী না হওয়ায় ফ্লাইওভারে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। ফ্লাইওভারে স্পিডব্রেকার ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে বেপরোয়া গাড়িচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

ফ্লাইওভারটি দিয়ে নিয়মিত চলাচল করে শ্রাবণ, নীলাচল, মৌমিতা, ঠিকানা, ইকবাল, হিমাচল, রজনীগন্ধাসহ বিভিন্ন কোম্পানির বাস। এসব বাসের কয়েকজন চালকের কাছে এ নিয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, তাদেরকে প্রতিদিন মালিকের জন্য জমার টাকার পাশাপাশি নিজের সংসার চালানোর খরচ তুলতে হয়। যানজটের কারণে পথে অনেক সময় নষ্ট হয়। তাই ফ্লাইওভারে ফাঁকা পেয়ে পথটা দ্রুত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেন। একই সঙ্গে ফ্লাইওভারের অপরপ্রান্তে থাকা যাত্রী ধরার জন্যও বাসগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে।

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার ব্যবহার করে নিয়মিত যাতায়াতকারী সাংবাদিক আরাফাত মুন্না বলেন, হানিফ ফ্লাইওভারের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে ফিটনেসবিহীন লোকাল বাসগুলো।

বিশেষ করে গুলিস্তান থেকে শনিরআখড়া, রায়েরবাগসহ সাইন বোর্ডে যাওয়া বাসগুলো ফ্লাইওভারের ওপরেই ওভারটেকিং করে। এ ছাড়া ফ্লাইওভারের ওপরে কোনো বাসস্ট্যান্ড না থাকলেও বিভিন্ন স্থানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করে; বিশেষ করে এক রুটের যাত্রী যখন অন্য রুটের বাসে চড়ে আসে, তারা ফ্লাইওভারে নেমে হেঁটে তার রুটে চলে যায়। এতেও দুর্ঘটনা ঘটছে।

হানিফ ফ্লাইওভারে নিয়মিত দুর্ঘটনার কারণ জানতে চাইলে ওয়ারী থানার ওসি কবির হোসেন হাওলাদার বলেন, ফ্লাইওভারে কোনো স্পিড ব্রেকার নেই। তাই চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান। স্পিড ব্রেকার নির্মাণ করা হলে দুর্ঘটনা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। সিসি ক্যামেরার সংখ্যাও বাড়াতে হবে।

সর্বশেষ খবর