মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বস্তিতে আলো ছড়াচ্ছে আলো ক্লিনিক

জয়শ্রী ভাদুড়ী

বস্তিতে আলো ছড়াচ্ছে আলো ক্লিনিক

রাজধানীর কড়াইল বস্তির আলো ক্লিনিকে সেবা নিচ্ছেন রোগীরা ছবি : জয়ীতা রায়

রাজধানীর কড়াইল বস্তির বাসিন্দা ওসমান আলীর বয়স ৭০ ছুঁই ছুঁই। জ্বর, কাশির উপসর্গ নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছিলেন তিনি। ডাক্তার দেখানো, ডেঙ্গু টেস্ট এবং ওষুধ সবই ফ্রিতে মিলছে। ভালো ব্যবহারের সঙ্গে ভালো সেবা পেয়ে সন্তুষ্টি বুথে নাতিকে সঙ্গে নিয়ে বাটন টিপে নিজের মতামত দিচ্ছিলেন তিনি। পাঁচ তারকা হাসপাতাল নয় রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে গড়ে ওঠা আলো ক্লিনিকের চিত্র এটি। এখানেই বস্তির ও আশপাশের দরিদ্র মানুষ পরিচ্ছন্ন পরিবেশে ডিজিটাল সিস্টেমের মধ্যে বিনামূল্যে মানসম্মত সেবা পাচ্ছে। 

ক্লিনিকে যাওয়ার পরই নাম, মোবাইল নম্বর দিয়ে সিরিয়ালের টোকেন নিতে হয়। টোকেন নেওয়ার পর সিরিয়াল অনুযায়ী নাম, মোবাইল নম্বর দিয়ে রেজিস্ট্রেশন শেষে ওজন, প্রেশার মাপাসহ বিভিন্ন ধরনের স্ক্রিনিংয়ের পর ডাক্তার দেখানো হয়। ডাক্তার দেখানো শেষে বিনামূল্যে ওষুধ বা টেস্টের স্যাম্পল দিয়ে সন্তুষ্টি বুথে সেবার মূল্যায়ন করে বের হয়ে যান রোগীরা।

আলো ক্লিনিক সুইডিশ সিডার অর্থায়নে এবং ইউনিসেফের কারিগরি সহায়তায় শহরের জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের দুই বছরের একটি পাইলট প্রকল্প। কড়াইল বস্তির পাশাপাশি মিরপুরের দুয়ারিপাড়া, শ্যামপুর শিল্প এলাকা, যাত্রাবাড়ীর ধলপুর, টঙ্গীর এরশাদ নগর ও নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে আলো ক্লিনিক আছে। শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল সাড়ে আটটা থেকে আড়াইটা ও তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত আলো ক্লিনিকে সেবা দেওয়া হয়। এ ক্লিনিকে প্রসূতি মা ও নবজাতকের চিকিৎসা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, ইপিআই টিকা, ডায়াবেটিস, অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা, মৌসুমি রোগসহ সাধারণ রোগের চিকিৎসা পায় রোগীরা। এখানে বিনামূল্যে অ্যান্টিবায়োটিক, স্যালাইন, জিঙ্ক, আয়রন ফলিক অ্যাসিড, হাইপারটেনশনের ওষুধসহ ২৩টি ওষুধ ফ্রিতে দেওয়া হয়। সিবিসি, ক্রিটিনিন, ইসিসি, ডেঙ্গু, ডায়াবেটিসসহ ১০টি টেস্ট বিনামূল্যে করা হয়। ক্লিনিকে দুজন পুরুষ ও দুজন নারী এমবিবিএস ডাক্তার থাকেন। প্রতি শিফটে একজন নারী ও একজন পুরুষ ডাক্তার থাকেন। প্যারামেডিক্স, নার্সসহ ১৪ জন স্টাফ এখানে সেবা দেন।

গত বুধবার কড়াইল বস্তির আলো ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, একটি দুই তলা ভবনের ওপর এ ক্লিনিক। সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই দেখা যায় টেবিল-চেয়ার নিয়ে তথ্য জানানো এবং সিরিয়াল নেওয়ার জন্য বসে আছেন হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। সেখান থেকে নাম মোবাইল নম্বর দিয়ে সিরিয়ালের টোকেন সংগ্রহ করছে রোগীরা। তারপর সেখান থেকে কিছুটা এগোলেই ক্লিনিক অ্যাসিস্ট্যান্টের টেবিল। সেখানে ক্লিনিক অ্যাসিস্ট্যান্ট রোগীর নাম, মোবাইল নম্বর ও প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে ক্লিনিকে রোগীর রেজিস্ট্রেশন করছে। এরপর পাশের প্যারামেডিক্সের রুমে গিয়ে ওজন, হাইপারটেনশন, তাপমাত্রা, অক্সিজেনের মাত্রা, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন ধরনের স্ক্রিনিং করছে। স্ক্রিনিং শেষে সিরিয়াল অনুযায়ী ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে রোগীরা।

কড়াইল আলো ক্লিনিকের ইনচার্জ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছরের ২১ ডিসেম্বর কড়াইলে আলো ক্লিনিক চালু হয়। শুরুতে কিছুদিন রোগী কম এলেও এখন প্রতি শিফটে ৯০ জনের বেশি রোগী আসে। বস্তিতে হলেও এখানে সব ধরনের রোগী আসে।

কড়াইল বস্তির পাশের টিএনটি কোয়ার্টারের অনেক সচ্ছল মানুষ এখানে আসে। তারা মূলত সার্ভিস নিতে আসে, কোথায় ক্লিনিক সেটা তাদের কাছে কোনো বিষয় নয়। আমাদের এখানে যেসব রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয় না সেসব রোগীকে বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার করা হয়। নভেম্বর মাসে কড়াইলের আলো ক্লিনিকে ১ হাজার ১৮১ জন পুরুষ, ২ হাজার ৫৯৬ জন নারী, ট্রান্স জেন্ডার দুজন, পাঁচ বছরের কম বয়সী ৮৫৫ শিশু সেবা নিয়েছে। এ ক্লিনিকে নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর ডে কেয়ার সেবা দেওয়ার জন্য দুটি বেড প্রস্তুত করা হয়েছে। শিগগিরই নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসা শুরু হবে।

আলো ক্লিনিক বিভিন্ন দেশের আরবান হেলথ কেয়ারের মডেল বিশ্লেষণ করে বানানো। এ মডেলটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার নিয়ে সরকারের হাতে কোনো মডেল নেই। আলো ক্লিনিক মডেলটি আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ারে আলো ছড়াচ্ছে। এটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিয়ে নেওয়া উচিত।’ আলো ক্লিনিক প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটির চেয়ারপারসন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, ‘আরবান হেলথ কেয়ারের দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় নেওয়ার পরিকল্পনা আছে। আলো ক্লিনিক ডিজিটালাইজডভাবে শহরের মানুষকে সেবা দিচ্ছে। আলো ক্লিনিক নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা রয়েছে।’

সর্বশেষ খবর