মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিপদ ঝুলছে মাথার ওপর তবু মাথাব্যথা নেই

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যমতে, ২০০২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৩৭৭ জন নির্মাণশ্রমিক।

জয়শ্রী ভাদুড়ী

বিপদ ঝুলছে মাথার ওপর তবু মাথাব্যথা নেই

 ছবি : রোহেত রাজীব

চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানার কল্পলোক আবাসিক এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের মো. ইস্রাফিল (২০), ঠাকুরগাঁওয়ের মো. রিপন (২০) এবং রাজশাহীর সাকিম আলী (২০)। ওই ভবনের অষ্টম তলায় কাজ করার সময় মাচা ভেঙে পড়ে মারা যান শ্রমিকরা। ভবনে কাজ চলাকালীন শুধু শ্রমিকদের নয়, পথচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিধান থাকলেও তার কোনো তোয়াক্কা নেই। ওপর থেকে ইট, রড পড়ে মারা যাচ্ছেন নির্মাণাধীন ভবনের নিচ দিয়ে যাতায়াতকারী পথচারীরা। এর আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের প্রেমতলায় নির্মাণাধীন একটি ভবনের পাঁচতলা থেকে ৩৭ কেজি ওজনের লোহার রড পড়ে নাহার বেগম (৩৯) নামে এক নারী মারা গেছেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্যমতে, গত বছর ১১৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে নির্মাণ খাতে। ২০২১ সালে ১৫৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২০২০ সালে নির্মাণ খাতে ৮৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৯ সালে ১৩৪ জন শ্রমিক মারা গেছেন। ২০০২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৩৭৭ জন নির্মাণশ্রমিক। এ মৃত্যুর বাইরে শ্রমিকদের পঙ্গু হওয়ার পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক। আহত হয়েছেন ৫২৫ জন শ্রমিক। এ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, মালিকদের অবহেলা, শ্রমিকদের সচেতনতার অভাব এবং শ্রম আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া এবং এ আইনের দুর্বলতার কারণে এমন অনাকাক্ষিত মৃত্যু ঘটছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণও পান না ভুক্তভোগী বা তার পরিবারের সদস্যরা। শ্রম আইন অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়োগকারীর। শ্রমিকের ব্যক্তিগত সুরক্ষা যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা ছাড়া নিয়োগকারী কাউকে কাজে নিয়োগ করতে পারবেন না।

আইনে এমন বাধ্যবাধকতা থাকলেও রাজধানীর একাধিক নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শন করে দেখা গেছে হেলমেট, গামবুট, নিরাপত্তা বেল্টসহ নিরাপত্তা উপকরণ ছাড়াই কাজ করছেন শ্রমিকরা। খিলক্ষেতে পাঁচতলা ভবনে চলছে নির্মাণকাজ। ছাদ ঢালাইয়ে কাজ করছেন শ্রমিকরা। কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়াই এক কোনায় ঢালাই সামগ্রী নিচ থেকে তুলে রাখা হচ্ছে। মাত্র একজন শ্রমিকের পায়ে গামবুট। তাও তার নিজের টাকায় কেনা। নিরাপত্তা ছাড়া কেন কাজ করছেন জানতে চাইলে শ্রমিক সিরাজুল ইসলাম ও হাজেরা খাতুন বলেন, ‘পেটের দায়ে কাজ করছি। দিন শেষে মজুরি পেলে তাই দিয়ে সংসার চলবে। নিরাপত্তার সামগ্রী চাইলে আমাদের কাজে নেবে না।’

এ সম্পর্কে ইমারত নির্মাণশ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশের (ইনসাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বলেন, শ্রম আইনে নিরাপত্তার বিষয় থাকলেও তা মানা হয় না। কর্তৃপক্ষ এগুলো তদারকি করে না। শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রম আইনে মালিক, শ্রমিক ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘সেফটি কমিটি’ গঠন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এই কমিটি গঠিত হয়নি। ফলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মালিকপক্ষকে চাপ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

ইনসাবের তথ্য অনুযায়ী, ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিক। ২০০৮ সালে কাকরাইলের আইরিশ নুরজাহান টাওয়ারে সংঘটিত দুর্ঘটনায় চার শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় হাই কোর্টের নির্দেশে প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবারকে ৮ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। কিন্তু এ রকম প্রতি বছর শত শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটলেও নিরাপত্তা কিংবা ক্ষতিপূরণ কোনোটাই দিচ্ছে না মালিকপক্ষ। শুধু শ্রমিকই নয়, নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া কাজ করায় ওপর থেকে ইট, রড পড়ে প্রাণ হারাচ্ছেন পথচারীও।

২০১১ সালের ১৬ জুলাই অসুস্থ মাকে হাসপাতালে দেখে ফেরার পথে পান্থপথে শমরিতা হাসপাতালের সামনে একটি নির্মাণাধীন ১৮তলা ভবন থেকে ইট পড়ে মারা যান তেজগাঁও কলেজের ছাত্র হাবিবুর রহমান। এ ঘটনার পর হাই কোর্ট বিভাগ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে একটি রিট জারি করে। পরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে আদালত নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেশে ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২ প্রচলিত আছে। এ ছাড়া ২০০৬ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা। এই আইন ও বিধিমালা অনুসারে ভবন নির্মাণে পথচারীদের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু অহরহ ভবন নির্মাণ হচ্ছে এসব নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই।

সর্বশেষ খবর