মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

দুর্ঘটনার হটস্পট হানিফ ফ্লাইওভার

♦ ১০ বছরে ১১৪৬ জনের মৃত্যু ♦ যেখানে সেখানে বাস থামিয়ে চলে যাত্রী ওঠানো-নামানো

জয়শ্রী ভাদুড়ী

দুর্ঘটনার হটস্পট হানিফ ফ্লাইওভার

ছবি : জয়ীতা রায়

মুন্সীগঞ্জ থেকে সকালের দিকে মোটরসাইকেল চালিয়ে ঢাকার অফিসের জন্য আসছিলেন সজীব হোসেন (৩২)। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর হানিফ ফ্লাইওভারে তিশা পরিবহনের বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যান তিনি। ১ নভেম্বর ঘটে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। শুধু সজীব নয়, গত ১০ বছরে এই ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ১৪৬ জন।

সড়কে দুর্ঘটনার কারণসহ নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্র (এআরআই)। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ফ্লাইওভারটিতে দুর্ঘটনার বেশির ভাগই হয় মোটরসাইকেলকেন্দ্রিক, অর্থাৎ মোটরসাইকেলের জন্য ফ্লাইওভারটি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকির কারণ হিসেবে ফ্লাইওভারটির জোড়ার (এক্সপানশন জয়েন্ট) বড় ফাঁকাকে দায়ী করা হয়।

ফ্লাইওভারটির ক্ষেত্রে আরও কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছে এআরআই। তাদের মতে, যানজট পেরিয়ে ফ্লাইওভারে উঠেই চালকরা যানবাহনের গতি বাড়িয়ে দেন। গতি নিয়ন্ত্রণে কোনো নজরদারি নেই। ফ্লাইওভারের ওপরে একটি যানবাহন অন্যটিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় থাকে, যাকে বলা হয় ওভারটেক। ফ্লাইওভারটির গুলিস্তান র‌্যাম্প দিয়ে ওঠা ও সায়েদাবাদ দিয়ে নামার সুযোগের কারণে একটি অংশে বাঁ দিকের চালকরা ডান লেনে, ডান দিকের চালকরা বাঁ লেনে যেতে চান। এই লেন পরিবর্তনও ঝুঁকি তৈরি করে।

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা বন্ধ হচ্ছে না। এ কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ফ্লাইওভারে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা, সায়েদাবাদ রেলক্রসিং, রাজধানী সুপার মার্কেট, গুলিস্তান এলাকায় বিভিন্ন রুটের বাস থামিয়ে যাত্রীদের ওঠানামা করানো হচ্ছে। ফ্লাইওভারে ওঠার জন্য বিভিন্ন জায়গায় তিনটি লোহার সিঁড়ি লাগানো হয়েছে। ফ্লাইওভারের ওপরেই গড়ে উঠেছে অস্থায়ী বাস স্টপেজ। যার মুখে এসে জটলা করছে বাস। বাস পেতে দ্রুত গতির ফ্লাইওভারের ওপরে ঝুঁকি নিয়ে মানুষ রাস্তা পার হচ্ছেন। উড়ালপথে হঠাৎ বাস থামায় ঘটছে দুর্ঘটনা। এসব কারণে শুধু ফ্লাইওভারে নামা বা ওঠার পথেই নয়, পুরো ফ্লাইওভার জুড়েই দেখা যায় দীর্ঘ যানজট। মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে গত ১০ বছরে দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। ১০ বছরে মোট দুর্ঘটনার মধ্যে ২ হাজার ৫৪২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এতে মারা গেছে ৪৯৯ জন। নির্দিষ্ট কোনো যানের ক্ষেত্রে যা তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি। এটি মোট মৃত্যুর ৪৪ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনায় আহত অন্তত ২ হাজার ১২৭ জন। সম্প্রতি সেভ দ্য রোড নামের একটি সংগঠনের প্রকাশিত প্রতিবেদনে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে ১০ বছরের এই দুর্ঘটনার চিত্র উঠে এসেছে।

সাড়ে ১১ কিলোমিটারের এই উড়াল সড়কে প্রতি তিন দিনে একজন করে মানুষ মারা যাচ্ছে। গত এক দশকে সব ধরনের যানবাহন মিলিয়ে আট হাজার ৩৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় অন্তত ৬ হাজার ৩১২ জন আহত হয়েছেন। যাত্রীবাহী বাসের তুলনায় পণ্যবাহী যানে মানুষের উপস্থিতি কম থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পণ্যবাহী যানে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা কম হয়।

কিন্তু গত ১০ বছরে হানিফ ফ্লাইওভারে ট্রাক দুর্ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৭৮৯টি। এতে ১৫৮ জন মারা গেছে। ১ হাজার ৩৭৩ জন আহত। ২ হাজার ৩৯৮টি বাস দুর্ঘটনায় ৩৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত ১ হাজার ৯০১ জন। দুর্ঘটনার এমন পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে সড়কটি কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, মাত্র সাড়ে ১১ কিলোমিটারের একটা ছোট্ট সড়কে ১০ বছরে ১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু অত্যন্ত অস্বাভাবিক। অথচ এটি আধুনিক অবকাঠামো। এখানে ব্যবস্থাপনার ঘাটতি প্রকাশ্য। ফ্লাইওভার তৈরি করা হয়েছে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোর জন্য। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন র‌্যাম্পের মুখে নিয়মিত বাসের যাত্রী নামানো হয়। এতে এক ধরনের দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। এটি অনেক সময় আরেকটি দ্রুতগতির গাড়ির জন্য আকস্মিক ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করে।

সর্বশেষ খবর