মঙ্গলবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা

আলী আজম ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা

ছবি : জয়ীতা রায়

রাজধানীর খিলক্ষেতে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন বেসরকারি সংস্থার কর্মী নূর-এ-আলম তৈমুর। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অফিসে যাওয়ার জন্য রেলক্রসিংয়ে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, এ সময় ট্রেন কাছাকাছি চলে এলেও খেয়াল না করে পার হচ্ছিলেন এক পথচারী। তাকে বাঁচাতে দৌড় দেন তৈমুর। পথচারী ওই ব্যক্তিকে বাঁচাতে পারলেও উল্টো দিক থেকে আসা ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারান তৈমুর। মাত্র সাড়ে সাত মাস বয়সে বাবার স্নেহবঞ্চিত হয় তৈমুরের সন্তান তীর্থ।

অরক্ষিত রেলক্রসিং, অসচেতনভাবে চলাফেরা, কানে হেডফোন দিয়ে চলা, মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইন পার হওয়ার ঘটনায় রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। ট্রেন আসার আগ মুহূর্তে যেসব জায়গায় লাইনম্যান দুই দিকে ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা পারাপার বন্ধ করে দেন, সেখানেও ব্যারিকেডের নিচ দিয়ে কিংবা একটু দূরে লোহার খুঁটি গলিয়ে ঢুকে পড়েন পথচারী এবং সাইকেল-মোটরসাইকেল চালকরা। ট্রেন কাছাকাছি চলে এলেও নির্বিকার পার হয়ে যান তারা। রাজধানীর শ্যাওড়াবাজার, আশকোনা, মগবাজার, এফডিসি মোড়, তেজগাঁও, মহাখালী, বনানী রেলক্রসিং ঘুরে দেখা যায় এমন চিত্র।

সরেজমিন খিলক্ষেত রেলক্রসিং এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন সকাল ৬টা ২০ মিনিট। বেচাকেনা জমে উঠেছে খিলক্ষেতে রেললাইন ঘেঁষে গড়ে ওঠা পাইকারি সবজি বাজারে। বাজার থেকে শাকসবজি কিনে ভ্যানে করে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। ট্রেন আসছে দেখেও অবলীলায় কাওলা রেলক্রসিং পার করছেন তারা। হালকা কুয়াশায় সামনে তাকালে দেখা যাচ্ছে ট্রেনের লাইট, হুইসেল বাজিয়ে এগিয়ে আসছে ট্রেন। মাত্র কয়েক হাত দূরে ট্রেন দেখে মাথায় বস্তা নিয়ে দৌড় দিলেন আরেক দোকানি। অল্পের জন্য ঢাকা-রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনের সঙ্গে দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গেলেন ওই ব্যক্তি। এভাবেই প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে রেললাইন পার হচ্ছেন মানুষ। জেনেবুঝেই দুই মিনিট সময় বাঁচানোর নামে জীবন বাজি রাখছেন তারা।

রেলওয়ে পুলিশ ঢাকা জেলা সূত্র জানায়, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকা রেলওয়ে জেলায় ৪০০ জন ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন। এর আগে, ২০২২ সালে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান ৪৬৭ জন। বছরে রেলে কাটা পড়ে যে মৃত্যু হয়, তার বড় একটি অংশ হয় ঢাকা রেলওয়ে জেলাতেই। রেল পুলিশের হিসাবেই বছরে গড়ে সেটি ৪ শতাধিক। জানা গেছে, আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলা এসব ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রায়ই পরিচয় মিলছে না অনেকের। প্রচার-প্রচারণা চালানোর পরও পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় অনেককে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করতে হচ্ছে। রেল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনার আসল সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। অথচ প্রতিবছর এই বিপুলসংখ্যক মৃত্যুর পরও রেললাইনগুলো ব্যবহার হচ্ছে হাঁটার পথ হিসেবে, অথচ এটি যে আইনত নিষিদ্ধ সেই খবরও অনেকেই রাখেন না। ট্রেন যখন ৮০-৮৫ কিলোমিটার গতিতে চলে, তখন এটি অন্য গাড়ির মতো ব্রেক করা সম্ভব হয় না। কাজেই ট্রেন তার গতিতেই যাবে।

রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মৃত্যুর বেশ কিছু কারণ রয়েছে। রেললাইনে হাঁটার সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা, কানে হেডফোন দিয়ে কথা বলা বা গান শোনার কারণে ৭০ শতাংশ লোকের মৃত্যু হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ ছাড়া অন্য কারণগুলো হচ্ছে- অরক্ষিত রেলক্রসিং দিয়ে দ্রুত পারাপারের চেষ্টা, ট্রেনের সঙ্গে যানবাহনের দুঘর্টনা, চলন্ত ট্রেন থেকে নামার সময়, রেললাইনের ওপর বসে থাকা, অসতর্কভাবে ট্রেন থেকে নামার সময়, অসতর্কভাবে রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটা বা চলাচল করা, চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুর ঘটনা তো আছেই। এসব ঘটনায় হাত-পা কাটা পড়ে কেউ কেউ চিরতরে পঙ্গু হচ্ছেন।’

সর্বশেষ খবর