মঙ্গলবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভয়াবহ ধুলাদূষণের কবলে ঢাকা

শামীম আহমেদ

ভয়াবহ ধুলাদূষণের কবলে ঢাকা

ছবি : জয়ীতা রায়

শীত আসতেই ফের ভয়াবহ ধুলাদূষণের কবলে রাজধানী ঢাকা। ধুলার জন্ম দেওয়া অনেক মেগাপ্রকল্প শেষ হলেও কমেনি দূষণ। সারাক্ষণই ধুলায় ধূসর হয়ে থাকছে ঢাকার আকাশ। সড়কের পাশের গাছের পাতায় জমেছে ধুলার পুরু আস্তর। পরিষ্কার পোশাক পরে খোলা যানবাহনে কয়েক কিলোমিটার ভ্রমণ করলেই নোংরা হয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ দিনই বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় শীর্ষে উঠে আসছে এই শহরের নাম। চিকিৎসকরা বলছেন, শীত আসতেই অ্যাজমা, নিউমোনিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের রোগীর ভিড় বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে।

এর পেছনে অন্যতম কারণ ধূলাদূষণ। শীতে ইউরোপে তাপমাত্রা মাইনাসে থাকলেও ধুলিদূষণ না থাকায় সেখানে শ্বাসতন্ত্রের রোগ খুব কম। বাতাসের অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা (পিএম ২.৫) ফুসফুসের গভীরে পৌঁছে মারাত্মক ক্ষতি করে। ফুসফুস ক্যান্সার সৃষ্টি, এমনকি রক্তে মিশে কিডনিকেও আক্রান্ত করে। এদিকে বাংলাদেশে যত মানুষ অকালে মারা যায়, তাদের ২০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ বলে ‘বিশুদ্ধ বায়ু পাওয়ার চেষ্টা : দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় উঠে এসেছে। তাতে দেখা গেছে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০ শহরের নয়টিই দক্ষিণ এশিয়ায়, যার মধ্যে ঢাকা একটি।

বিশ্ব বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের প্রতিবেদনে গতকাল সরকারি ছুটির দিনে বিকাল তিনটায় বায়ুমান সূচকে (একিউআই) ১৮৪ স্কোর নিয়ে বিশ্বের তৃতীয় দূষিত বায়ুর শহর ছিল ঢাকা। এই স্কোরকে অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ক্ষতিকর দূষণ উপাদান পিএম ২.৫ ছিল ১১৯.৬ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া নিরাপদ সীমার (বার্ষিক গড়) চেয়ে ২৪ গুণ বেশি। এ সময় বায়ুদূষণে শীর্ষে ছিল পাকিস্তানের লাহোর, দ্বিতীয় স্থানে ছিল ভারতের দিল্লি। এক ঘণ্টা পরই বিকাল ৪টায় ঢাকার একিউআই স্কোর বেড়ে দাঁড়ায় ২১৬, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম ২.৫ ছিল নিরাপদ সীমার চেয়ে ৩৩ গুণ বেশি। তবে ২৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ঢাকার বাতাস ছিল বিপজ্জনক মাত্রায় দূষিত। একিউআই স্কোর ছিল ৩০০-এর বেশি। গত ২৬ নভেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত এক মাসে এক দিনও ভালো বাতাস পায়নি ঢাকাবাসী। এর মধ্যে ১৩ দিন ছিল অস্বাস্থ্যকর, ১৭ দিন ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর।

কোনো এলাকায় একিউআই স্কোর ৫০-এর নিচে থাকলে তাকে স্বাস্থ্যকর ধরা হয়। স্কোর ৫১ থেকে ১০০ হলে সহনীয়, ১০১ থেকে ১৫০ বিশেষ শ্রেণির মানুষের জন্য অস্বাস্থ্যকর, ১৫১ থেকে ২০০ হলে অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ খুবই অস্বাস্থ্যকর ও ৩০১ থেকে ৫০০ হলে তা বিপজ্জনক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার দূষণ নিয়ে বারবার উচ্চ আদালতের কঠোর বার্তা সত্ত্বেও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো উদাসীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুদূষণ বিষয়ক গবেষক ড. আবদুস সালাম বলেছেন, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাস দূষণ বাড়তেই থাকে।

এই সময়ে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় দূষণের উপাদান বাতাসেই রয়ে যায়। নির্মাণবিধি না মেনে বিভিন্ন নির্মাণকাজ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, খোলা ট্রাকে মাটি-বালু পরিবহন ও ট্রাফিক জ্যামের কারণে দূষণ বাড়ছে। চাতাল, ইটভাটা এগুলোও চলে শীতকালে। দূষিত বায়ুর কারণে নানা রোগ হচ্ছে।  দূষণের উৎস বন্ধ করতে আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই।

সরেজমিন দেখা গেছে, সড়কে ট্রাকে ইট-বালু-সিমেন্ট পরিবহন করা হচ্ছে খোলা অবস্থায়। প্রচুর ধুলা উড়াচ্ছে এসব ট্রাক। বালুবোঝাই ট্রাকের পেছনে থাকা যানবাহনগুলোকে বিপদে পড়তে হচ্ছে। প্রতিটি সড়কের দুই পাশে জমেছে ধুলার আস্তর। এর ওপর দিয়ে যানবাহন যাওয়ার সময় আশপাশের এলাকা ধুলায় ধূসর হয়ে যাচ্ছে। সড়কের পাশের কাঁচাবাজার, রেস্টুরেন্ট, চায়ের দোকানের জৈব ও অজৈব বর্জ্য ফেলা হচ্ছে রাস্তায়।

এগুলো শুকিয়ে ধুলায় পরিণত হচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত নির্মাণকাজে কোথাও ধুলা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। দূষণ কমাতে সড়কে নির্মাণসামগ্রী না রাখতে দুই সিটি করপোরেশনের নির্দেশনা পাত্তাই দিচ্ছেন না কেউ। এ ছাড়া কিছু অভিজাত এলাকা ছাড়া রাজধানীর অধিকাংশ ওয়ার্ডের রাস্তাঘাটের করুণ দশা। ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে প্রতিটি যানবাহন যাওয়ার সময় ধুলোয় ঢেকে যাচ্ছে আশপাশের দোকান-বাড়িঘর। রাজধানীর বাসিন্দারা বলছেন, দরজা-জানালা বন্ধ রাখার পরও ঘরের আসবাব-ফ্লোর দিনের মধ্যে কয়েকবার মুছতে হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর