মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

প্রযুক্তিজালে বন্দি নাগরিক জীবন

জয়শ্রী ভাদুড়ী

প্রযুক্তিজালে বন্দি নাগরিক জীবন

ছবি : রোহেত রাজীব

প্রযুক্তিকেন্দ্রিক বিনোদনে ঝুঁকছেন মানুষ। শিশু, তরুণ, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ ঝুঁঁকছেন সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, টেলিভিশনের দিকে। নিজেদের সময় দেওয়ার বদলে মোবাইল, ল্যাপটপের স্ক্রিনে বেশি সময় দিচ্ছেন সবাই। প্রযুক্তির জালে বন্দি হয়ে পড়েছে নাগরিক জীবন। রাজধানীতে শিশুদের খেলার মাঠ, খোলা জায়গার ভীষণ সংকট। শহরে স্বল্প জায়গার বাসায় শিশুদের বড় করে তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা। তাই শিশুদের বিনোদন দিতে সহজমাধ্যম হিসেবে বসিয়ে দিচ্ছেন টেলিভিশনের সামনে। কার্টুন দেখতে দেখতে খাওয়া-ঘুম সবই চলে। টেলিভিশনে কার্টুন পছন্দ না হলে মোবাইলে ইউটিউবে চোখের সামনে চলে ভার্চুয়াল জগতের দৌড়ঝাঁপ। ভার্চুয়াল জগতের গতিকেই বাস্তব মনে করে শিশুরা। ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থেকে দুটি জাগরিত চোখকে সারাক্ষণ নিবদ্ধ রাখে মোবাইল স্ক্রিন, ল্যাপটপ কিংবা টিভির পর্দায়। বই পড়াতেও নেই আগ্রহ। 

বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা শামসুল সিদ্দিকি বলেন, গ্রামের খোলা জায়গায় শিশুরা তবু হেসে-খেলে কিছুটা সময় কাটাতে পারে। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে। রাজধানীর এই দুই রুমের বাসায় ঠিকমতো আলো-বাতাস  ঢোকে না। দিনের পর দিন ছেলেমেয়েদের কীভাবে আটকে রাখি। ছাদে যাওয়ার অনুমতিও নেই। কিছুদিন ওদের বই পড়তে উৎসাহিত করেছিলাম। কিন্তু অনলাইন থেকে কিছুতেই দূরে রাখা যাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই ফোন হাতে তুলে দিতে হচ্ছে। শুধু শিশুরা নয়, সব বয়সী মানুষের প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। বেড়েছে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রবণতা।

অনেকক্ষণ ধরে স্ক্রিনে থাকার কারণে সবার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে থাকে এবং কথা বলতে ভালো লাগে না। চোখ টনটন করতে থাকে, ঘাড় ব্যথা করে, হাত অবশ হয়ে যায় মাঝে মাঝে। এতে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কিন্তু কম নয়। ২০১৪ সালে অস্ট্রিয়ার একদল গবেষক কয়েক হাজার নারী-পুরুষের ওপর গবেষণা চালান। এদের একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে না, অন্য অংশ বিশেষভাবে এর প্রতি আসক্ত। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ব্যবহার করেন না তাদের চেয়ে যারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়মিত ব্যবহার করেন তাদের মেজাজ বেশি খিটখিটে এবং অস্থির মনের। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিরিনা রহমান বলেন, অনেক সময় চিন্তা করি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাব না। কিন্তু একবার চালাতে শুরু করলে আর বের হতে পারি না। বাবা ল্যাপটপে অফিসের কাজ করেন, মা আর ভাই নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখেন। খাওয়ার টেবিল ছাড়া আমাদের কথাই হয় না। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে আমরা অসামাজিক হয়ে পড়ছি। সব বুঝতে পারি তবুও এই আসক্তি থেকে বের হতে পারছি না।

উল্লেখ্য, করোনা মহামারি শুরুর পর বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যায়। সম্প্রতি এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির মূল প্রতিষ্ঠান মেটা জানায়, ফেসবুকে সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ তিনে। বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা গত বছরের জানুয়ারিতে ছিল প্রায় ৪ কোটি ৬৫ লাখ ৪৮ হাজার। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ ফেসবুক ব্যবহার করে। যার মধ্যে পুরুষ ব্যবহারকারী প্রায় ৬৮ শতাংশ। ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি (৪৪ শতাংশ) ফেসবুক ব্যবহার করেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ পরিচালিত একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, শহরে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে ৬২ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত; যা উদ্বেগজনক। শুধু তাই নয়, ২০২১ সালে ৫২০ জন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবককে নিয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কভিড-১৯-এর সময় অনেক বাংলাদেশি যুবক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ে, যারা বর্তমানে বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় ভুগছে। আরেক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ফেসবুকে আসক্ত। স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা এবং সাশ্রয়ী মূল্যের ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ ব্যাপারে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ডা. এম মোহিত কামাল বলেন, প্রতিদিন অসংখ্য তরুণকে আমরা চিকিৎসা দিয়ে থাকি। তাদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউবসহ অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। তারা ভার্চুয়াল দুনিয়ার মতো বাস্তবেও সবকিছু ওভাবেই পেতে চায়। এতেই বাধে বিপত্তি। এখন সব বয়সী মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের আসক্তি বেড়েছে। মাদকের চেয়ে কোনো অংশে এই আসক্তি কম নয়। ঘুম কমিয়ে মনকে অসুস্থ করে দিচ্ছে অত্যধিক প্রযুক্তির ব্যবহার।

সর্বশেষ খবর