মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

সিগন্যাল অমান্য করলেই অটো মামলা

আলী আজম

ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

ছবি : জয়ীতা রায়

ঢাকার গুলশান-২ এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) সিগন্যাল সিস্টেম বসানো হয়েছে। এর মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে সব ধরনের গাড়ির গতিবিধি। সিগন্যাল ছাড়ার আগে-পরে কতগুলো গাড়ি ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করেছে তা ধরিয়ে দিচ্ছে এআই ক্যামেরা। যানজট কমানো ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এ উদ্যোগ নিয়েছে। শুধু যানবাহনই নয়, ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারী পথচারীদের গতিবিধিও নজরদারিতে রাখা যাবে এর মাধ্যমে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সিস্টেম চালু হলে রাজধানীজুড়ে একদিকে ভয়াবহ যানজট কমবে, অন্যদিকে যত্রতত্র পার্কিং কিংবা ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করার প্রবণতাও কমে আসবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরে যেভাবে প্রতিদিন গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে সেভাবে ঢাকার রাস্তা বাড়ছে না। বরং অনেকাংশে রাস্তা কমছে। যানজটের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি যেমন হচ্ছে তেমন কর্মঘণ্টাও কমছে। ঢাকা শহরে বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ছুটির দিনেও রাস্তায় চলাচল করা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ভালো না হলে ঢাকার যতই উন্নয়ন হোক না কেন তা কাজে আসবে না। পুলিশ সদস্যরা হাত দিয়ে যে ট্রাফিক সিগন্যাল দিতেন এআই চালু হলে তা আর দেওয়া লাগবে না। ঢাকার রাস্তায় শৃঙ্খলা আনতে এআই সিগন্যাল সিস্টেমের বিকল্প নেই।

বিআরটিএ পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা শহরে ২০২২ সালে নতুন গাড়ি রেজিস্ট্রেশন হয়েছে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৮১২টি এবং ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত নতুন গাড়ি রেজিস্ট্রেশন হয়েছে ৮৭ হাজার ৩৬২টি। তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি রেজিস্ট্রেশন হয়েছে মোটরসাইকেল, ১ লাখ ২০ হাজার ৮৪৮টি। এরপর রয়েছে প্রাইভেটকার ১৪ হাজার ৯৪৬টি, জিপ ৯ হাজার ৩৫০টি এবং মাইক্রোবাস রেজিস্ট্রেশন হয়েছে ৬ হাজার ৬৯৫টি। প্রতি বছরই গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে।

দেখা গেছে, হাত দিয়ে ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি থামার সিগন্যাল দিলেও অনেক গাড়ি সিগন্যাল ভেঙে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করে। অনেক সময় ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা দৌড়ে গিয়ে গাড়ি থামাচ্ছেন এবং ব্যবস্থা নিচ্ছেন, আবার অনেক সময় চালক সিগন্যাল অমান্য করে দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন (এআই) সিগন্যাল মেনটেন্যান্স সরঞ্জাম, সিসি ক্যামেরা, ইমেজ ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা ও অন্য সরঞ্জামাদি দিয়ে এআই চালু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে রাজধানীর প্রতিটি পয়েন্ট এআই-এর আওতায় আনা হবে।

জানা গেছে, প্রতি মাসে গুলশান-২ মোড়ের সিগন্যালে ট্রাফিক আইন ভাঙছে ৩ লাখ গাড়ি। ডিএনসিসির তথ্য বলছে, এ এলাকার গাড়ি চলাচল পর্যবেক্ষণ করে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা ভয়াবহ। আইন ভাঙার প্রবণতা বেশি। পূর্ণাঙ্গভাবে ঢাকা শহরে এ পদ্ধতি চালু হলে মামলা হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। তখন যানজট নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। এর সুফল ভোগ করবে নগরবাসী। এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালু রয়েছে। ডিএনসিসির এক কর্মকর্তা বলছেন, এআই প্রযুক্তিসম্পন্ন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা প্রাথমিকভাবে চালু হবে গুলশানসহ ১৭টি পয়েন্টে। সাফল্য এলে ক্রমান্বয়ে ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ সবকটি পয়েন্টে এই সেবা চালু করা হবে।

নগরবাসী বলছেন, ঢাকায় গাড়ি চালকদের আইন ভাঙার প্রবণতা, যত্রতত্র পার্কিং, লেন মেনে গাড়ি না চালানো, জেব্রা ক্রসিংয়ের ওপর দাঁড়ানো নিয়মিত ঘটনা। রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানামা করা হচ্ছে। বেশির ভাগ গাড়িই নির্দিষ্ট লেনে চলে না। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে এআই সিস্টেম চালু হলে ঢাকা শহরের যানজট এবং দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে।

বিশ্ব ট্রাফিক সূচক ২০২০ অনুযায়ী, জরিপ করা ২৪১টি শহরের মধ্যে খারাপ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ঢাকা সপ্তম। এর অন্যতম কারণ হাতের ইশারায় ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে দিন দিন দেশ ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতির জন্য অবিবেচনাপ্রসূত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবাস্তব প্রকল্প এবং জনাকীর্ণ রাস্তায় নতুন যানবাহনের জন্য অপরিকল্পিত অনুমোদনকে দায়ী করেছেন। বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) জানিয়েছে, গত বছর যানজটের কারণে দেশে আনুমানিক ৫৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

গুলশান-২ নম্বর সিগন্যালে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা বলছেন, লালবাতি জ্বলা অবস্থায় সাদা দাগ অতিক্রম করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রাফিক মামলা হবে। গাড়ির লাইসেন্স ও মেয়াদ না থাকলেও ধরা পড়বে ক্যামেরায়। এ প্রযুক্তির ফলে অনেকেই সচেতন হয়েছেন। এতে ট্রাফিক আইন ভাঙার প্রবণতা কমে আসবে ৯৯ শতাংশ। লালবাতি জ্বলা মাত্র সবাই সতর্ক হয়ে যাবেন। এই আধুনিক ব্যবস্থাপনায় ট্রাফিক পুলিশের কষ্টও কমে আসবে।

ডিএমপির গুলশান ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আব্দুল মোমেন বলেন, গুলশান-২ নম্বর সিগন্যালে পরীক্ষামূলকভাবে সিটি করপোরেশন এ পদ্ধতি চালু করেছে। লাল, হলুদ আর সবুজ বাতিতে এখনো গাড়ি চালকরা নির্ভরশীল। ইন্টেলিজেন্স ক্যামেরাসহ আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন এআই সিস্টেম ঢাকা শহরের একযোগে গুরুত্বপূর্ণ সব কয়টি পয়েন্টে চালু হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, এআই সিস্টেমে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের তথ্য পেলেও এখনই শাস্তি দিতে পারছে না সিটি করপোরেশন। কারণ, শাস্তি দেওয়া পুলিশের কাজ আর সে উদ্দেশ্যে পুলিশের ডেল্টা-৩ সিস্টেমের সঙ্গে এই সিস্টেমের সমন্বয়ের কাজ চলছে। সমন্বয়ের কাজ হয়ে গেলে শাস্তি চালু করা সম্ভব হবে।

সর্বশেষ খবর