মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

ঘুমের কষ্টে নগরের মানুষ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ঘুমের কষ্টে নগরের মানুষ

রাতজাগা ভাসমান মানুষ খোলা আকাশের নিচে ঘুমের ক্লান্তি নিবারণের চেষ্টা করেন। রাজধানীর কাকরাইল মোড়ের ফুটপাতে এভাবেই মুঠোফোন বন্দি হন তারা - বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রায় ২ কোটি মানুষের এই নগরীতে পথে পথে ঘুমায় হাজার হাজার মানুষ। যাদের মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই নেই। ঘুমের কষ্ট নিয়ে জীবন কাটায় এসব ভাসমান মানুষ। কিন্তু নিজের ঘরের নিশ্চিত নিরাপত্তায় যারা থাকেন তাদেরও ঘুমের কষ্ট কম নয়। মেগাসিটির চোখ ধাঁধানো আলো, অসংখ্য ডিজিটাল ডিভাইস, কষ্ট, হতাশা, অনিশ্চয়তা আমাদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। প্রাচুর্য প্রদর্শনীর এই রাজধানীতে রাত নামলেও ঘুম নামে না। তীব্র আলোর ঝলকানিতে নিদ্রাদেবীর দেখা মিলে না। নিষ্পলক অনিদ্রায় কেটে যায় লাখো মানুষের রাতের প্রহর। এই বাস্তবতায় মার্চের তৃতীয় শুক্রবার গত ১৫ মার্চ বিশ্ব ঘুম দিবস পালিত হলো দেশে। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘সবার জন্য ঘুমের সমতা’।

পরিপূর্ণ ঘুমের জন্য রাত হলো আদর্শ সময়। কিন্তু আমাদের নগরে রাত আসে কোলাহলমুখর উদ্দামতা নিয়ে। রাজধানীর রাত কখনো ঘুমায় না। রাত জেগে থাকে নানানরকম স্বার্থপরতা নিয়ে। জীবনের নানানরকম তাগিদ ও তাড়না নিয়ে। আমাদের বিত্তবৈভবের যতই উন্নতি হচ্ছে রাতের নিস্তব্ধতা ততই হারিয়ে যাচ্ছে। নিদ্রাহরণের এই রাত আমাদের অনেকের জন্য আর প্রশান্তি বয়ে আনে না।

সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। রাতে ঠিকমতো ঘুম না হলে পরদিন সকাল থেকেই কর্মকান্ডে এর প্রভাব পড়ে। বিশ্বে ৭৮ থেকে ৭৯ ধরনের ঘুমজনিত সমস্যা রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে পূর্ণবয়স্ক দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ সঠিকভাবে ঘুমাতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিদ্রা ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সেখানে প্রাপ্তবয়স্কদের ৬০ শতাংশই সপ্তাহে দুই রাত বা তার বেশি সময় ঘুমজনিত সমস্যায় ভোগেন। শতকরা ৪০ জনের বেশি লোক মাসে অন্তত দুই দিন অতি দিবা নিদ্রালুতায় আক্রান্ত হয়ে কর্মক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হন। ঘুম নিয়ে বাংলাদেশে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। তাই আমাদের দেশের কত সংখ্যক মানুষ অনিদ্রায় ভোগেন এবং তার কারণ কী, সে সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে নাগরিক জীবনে কম ঘুমানো মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বাস-ট্রেনের জানালায়, অফিসের টেবিলে, ডিউটির ফাঁকে ঢুলু ঢুলু চোখের মানুষদের দেখলেই বোঝা যায়, ঘুমের কষ্টে তাদের প্রশান্তি উধাও। বিশ্বের প্রায় ৫০ লাখ মানুষের ওপর পরিচালিত ১৫৩টি গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কম ঘুমের কারণে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, বাচ্চারা স্মৃতি হারায় এবং তাদের মেধা কমে যায়। কম ঘুমের কারণে স্নায়ুর সমস্যা, স্থূলতা, আলঝেইমারের আশঙ্কাও বাড়ে।

গবেষকরা বলছেন, করোনা মহামারির কারণে অনেকে জীবিকা হারিয়েছেন। অনেকের জীবিকা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। জীবিকার চিন্তায় অনেকের ঘুম কমেছে, ঘুম নষ্ট হয়েছে। তাঁরা আর আগের মতো নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারছেন না। করোনার কারণে অনেককে বাড়িতে-ঘরে বেশি সময় আবদ্ধ থাকতে হয়েছে, তাই নতুন অভ্যস্ততায় অনেকের ঘুমের অভ্যাস বদলে গেছে। বাড়িতে-ঘরে থেকে টেলিভিশন দেখা বা মোবাইল ফোন-কম্পিউটার ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে শিক্ষার্থীদের। এসব ইলেকট্রনিক ডিভাইস ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর যেসব সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে, তার অন্যতম অনিদ্রা ও ঘুমের অন্য কিছু সমস্যা।

শারীরিক সুস্থতা এবং মানসিক প্রশান্তির এক বড় নিয়ামক ঘুম। একজন মানুষের পর্যাপ্ত ঘুম না হলে তার শরীরের প্রাকৃতিক ছন্দ বিনষ্ট হয়। তাই ঘুমকে মোটেও তুচ্ছ করে দেখার নয়। কিন্তু যারা ঘুমের সমস্যায় ভোগেন তারাই কেবল বুঝতে পারেন এর মর্ম। সারা রাতের ঘুমের ওপরই অনেকটা নির্ভর করে সারা দিনের পারফরমেন্স। একজন মানুষকে অন্তত ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। এটাই একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের ঘুমানোর আদর্শ পরিমাণ। বর্তমান সময়ে ঘুম-সংক্রান্ত অনেক রোগ যেমন দীর্ঘস্থায়ী ঘুমের অভাব এবং ঘুমের ব্যাঘাতের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, বিষণ্ণতা, হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকসহ অনেক গুরুতর সমস্যার ঝুঁকি দেখা দিচ্ছে। তাই ঘুম-সংক্রান্ত এই সমস্যাগুলো এড়াতে, ওয়ার্ল্ড স্লিপ সোসাইটি ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো ঘুম দিবস শুরু করে। সেই থেকে প্রতি বছর মার্চ মাসের তৃতীয় শুক্রবার বিশ্ব ঘুম দিবস পালিত হয়। এখন বিশ্ব ঘুম দিবস ৮৮টিরও বেশি দেশে পালিত হয়।

‘অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া’ বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের নাক, কান ও গলা সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন, সুস্থ থাকতে নিয়মিত ৮ ঘণ্টা ঘুমের বিকল্প নেই। তবে বলা যায়, এখন ঘুমের মহামারি চলছে। কারণ বেশির ভাগ মানুষেরই রাতের খাবার খাওয়া ও ঘুমাতে যাওয়ার সময় মেনে চলার অভ্যাস নেই।

সর্বশেষ খবর