শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

মুটিয়ে যাচ্ছেন নগরের মানুষ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

মুটিয়ে যাচ্ছেন নগরের মানুষ

ছবি : জয়ীতা রায়

বেসরকারি আইটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন রাইসুল হোসেন। ৩৪ বছর বয়সী রাইসুলের ওজন ১০০ কেজির ঘর ছুঁই ছুঁই। শরীরে বাসা বেঁধেছে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগ। চিকিৎসকের পরামর্শে প্রতিদিন সকালে  হাতিরঝিলের পাশের ফুটপাতে হাঁটতে বের হন তিনি। রাইসুল বলেন, ‘ওজন বেড়ে যাওয়ায় নানা ধরনের জটিলতা হতে শুরু করে। ডায়াবেটিস দেখা দিয়েছে, ইউরিক অ্যাসিড বেড়েছে, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছি। চিকিৎসক ওষুধের পাশাপাশি প্রতিদিন এক ঘণ্টা হাঁটতে বলেছেন। খাবারের তালিকায় পরিবর্তন এনে ওজন কমিয়ে সুস্থ থাকার চেষ্টা করছি।’

মুটিয়ে যাচ্ছে মহানগরের বাসিন্দারা। এ সমস্যা শুধু আর শহরের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। গ্রাম-শহর সব জায়গায় শিশু, তরুণ, পৌঢ়, বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষ স্থূলতার সমস্যায় ভুগছেন। এটা শুধু দেশের নয়; বিশ্বের অন্যান্য দেশেও প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশ্বে ১০০ কোটির বেশি মানুষ স্থূল বলে মনে করা হচ্ছে। স্থূলতার কারণে অনেক গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং গবেষকদের আন্তর্জাতিক গ্রুপগুলোর হালনাগাদ হিসেবে এ তথ্য জানা যায়। অনেক নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ, যেসব দেশের মানুষ অপুষ্টিতে ভুগতেন, এখন সেসব দেশসহ বেশির ভাগ দেশে কম ওজনের চেয়ে স্থূলতা সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠেছে।

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন দ্য ল্যানসেটে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা প্রতিবেদনের জ্যেষ্ঠ লেখক ও ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের একজন অধ্যাপক মাজিদ ইজ্জতি বলেন, স্থূলতা নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষের সংখ্যা চমকে দেওয়ার মতো। ১৯৯০ সালে বিশ্বে প্রাপ্তবয়স্ক, কিশোর ও শিশুদের মধ্যে ২২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ স্থুলতার সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০২২ সালে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৩ কোটি ৮০ লাখ।

ইজ্জাতি বলেন, অনেক উন্নত দেশকে স্থূলতা বৃদ্ধির উর্বর ভূমি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এখন আর এটি শুধু সেসব দেশে সীমাবদ্ধ নয়। বৈশ্বিকভাবে যদিও কম ওজনের বিষয়টি সচরাচর কমই দেখা যাচ্ছে। তবে বিষয়টি এখনো অনেক দেশে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বিশ্বের অনেক দেশ অপুষ্টি ও স্থূলতার এই সমস্যা, যা ‘ডাবল বোঝা’ হিসেবে পরিচিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।

এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পুষ্টিবিষয়ক প্রধান ফ্রান্সেসকো ব্রানকা বলেন, ‘অতীতে আমরা মনে করতাম, স্থূলতার এই সমস্যা কেবল ধনী দেশগুলোর। বাস্তবতা হচ্ছে, স্থূলতা বিশ্বের একটি সমস্যা। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্থূলতার হার দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। আর পাঁচ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিশু ও কিশোরদের মধ্যে এই হার চার গুণের বেশি বেড়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একই সময়ে কম ওজনের ছেলে, মেয়ে ও প্রাপ্তবয়স্কদের সংখ্যা যথাক্রমে এক-পঞ্চমাংশ, এক-তৃতীয়াংশ ও অর্ধেক কমে গেছে।

ইজ্জতি বলেন, নব্বইয়ের দশকের আগে থেকে প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, শিশুদের মধ্যে স্থূলতা বৃদ্ধির হার খুবই উদ্বেগের। আবার একই সময়ে দেখা গেছে, লাখ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছেন না। অত্যন্ত কম ওজন শিশুদের বিকাশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। আর সবচেয়ে চরম অবস্থা হলো- মানুষ অনাহারে মারা যেতে পারে। স্থূল মানুষেরও অকালমৃত্যু হতে পারে। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনির রোগসহ বিভিন্ন ধরনের গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।

২০১৭ সালের পর এই প্রথম স্থূলতা নিয়ে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ হলো। নন-কমিউনিক্যাবল ডিসিস রিস্ক ফ্যাক্টর কোলাবোরেশনে দেড় হাজারের বেশি বিজ্ঞানী রয়েছেন। সেখানে দেখা গেছে, পাঁচ বছরের বেশি বয়সী প্রায় ৭৭ কোটি ৪০ লাখ মানুষ স্থূল। বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার হিসাবে প্রতি আটজনে একজন স্থূলতার সমস্যায় ভুগছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. তেদরোস আধানম গেব্রিয়াসুস বলেন, স্থূলতার হার মোকাবিলায় মিষ্টিজাতীয় খাবারের ওপর কর আরোপ এবং স্কুলে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পরিবেশনের মতো পদক্ষেপ নিতে হবে।

ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্থূলতার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। শারীরিক পরিশ্রম কমে যাওয়া, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনের পরিবর্তনের কারণে ওজন বেড়ে যাওয়াসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। এর ফলে ডায়েবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ইউরিক অ্যাসিড, হৃদরোগ, কিডনি রোগ হচ্ছে। অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার, প্রসেস ফুড খাবার প্রবণতা বাড়ছে। শিশুরাও এসব খাবারে আসক্ত হচ্ছে। নিয়মিত হাঁটা, শারীরিক কসরত বাড়ানো এবং পরিমিত পরিমাণে সুষম খাবার খেলে স্থুলতার সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে।’

সর্বশেষ খবর