রাজধানীর বুড়িগঙ্গা তীরে জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ মেরামতের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের বিপরীত দিকে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধ শতাধিক ডকইয়ার্ড। এসব ডকইয়ার্ডের মাধ্যমে দেশের নৌ পরিবহন খাতের বড় চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। নৌযান নির্মাণ ও মেরামতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বুড়িগঙ্গা তীরের ডকইয়ার্ডগুলো।
সরেজমিনে দেখা যায়, টুংটাং শব্দে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা। কেউ জাহাজের রং তুলছেন। কেউ লোহার শিট ঝালাই করছেন। কেউ প্রপেলার লাগানোর কাজে ব্যস্ত। পুরনো জাহাজের বডি থেকে লোনা তোলা হচ্ছে। অনেক জাহাজে সাগরের লোনা পানিতে মরিচা ধরেছে। এসব রং করায় ব্যস্ত শ্রমিকরা। এ ছাড়া জাহাজের বিভিন্ন ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্য এখানে তৈরি হয়। এক সময় প্রপেলার দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা হতো। বর্তমানে কেরানীগঞ্জে তা তৈরি হয়। আকার ভেদে একেকটি জাহাজ নির্মাণ করতে ছয় মাস থেকে এক বছর লেগে যায়। ক্ষেত্রবিশেষে দুই বছরও লাগে। নতুন জাহাজ নির্মাণ শেষে বিআইডব্লিউটিএ থেকে চলাচলের অনুমতিপত্র সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরে পাঠায়।
কেরানীগঞ্জের ডকইয়ার্ডে প্রায় শতাধিক ঠিকাদার জাহাজ মেরামত ও নির্মাণের কাজে নিয়োজিত। ডকইয়ার্ড মালিকরা মূলত পঞ্চাশের দশকে এখানে কাঠের জাহাজ ব্যবসা শুরু করে। তবে স্বাধীনতার পরপরই ডকইয়ার্ড শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। পর্যায়ক্রমে আধুনিকতার স্পর্শে এসে স্টিলের জাহাজ নির্মাণ শুরু হয়। বর্তমানে এসব ডকইয়ার্ডে বছরে বিভিন্ন সাইজের প্রায় শতাধিক যাত্রীবাহী ও মালবাহী জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত হচ্ছে। আকার ভেদে একেকটি জাহাজ নির্মাণে খরচ পড়ে ৬০ লাখ থেকে ৭-৮ কোটি টাকা পর্যন্ত। কেরানীগঞ্জ ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, খুলনা এবং বরিশালেও অনুরূপ ডকইয়ার্ড শিল্প রয়েছে। ডকইয়ার্ড মালিকরা জানান, ঢাকার কেরানীগঞ্জে এ ইয়ার্ড শিল্প এলাকাই দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড়।
ডকইয়ার্ড মালিকরা জানান, বর্তমানে জাহাজ মালিকরাই কোনো রকম টিকে আছে। একটি জাহাজ বাৎসরিক মেরামত করতে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা লেগে যায়। জাহাজ মালিকরা এখন স্টাফের বেতন দিতে পারছেন না। জাহাজের মেরামত তো দূরের কথা। মালিকদের ভুলের কারণে এ শিল্প কোনো রকমে টিকে আছে। যারা সমিতির সঙ্গে যুক্ত নয় তাদের অবস্থা আরও তলানিতে। জাহাজের অবস্থা শোচনীয় হলেও তারা মেরামত করতে পারছে না। যার জন্য ডকইয়ার্ডগুলো গত এক বছরে প্রায় ফাঁকা ছিল। এ সময় লাভ দূরে থাক স্টাফের বেতন দেওয়া মুশকিল হয়ে গেছে। নিয়মিত স্টাফের সঙ্গে সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক স্টাফরা কাজ পাচ্ছেন না। এখন আর আগের মতো আয় নাই। শিপিং সেক্টর এখন খারাপ সময় পার করছে। এক সময়ে জাহাজে পূর্ণ থাকত ডকইয়ার্ডগুলো। এখন উল্টো চিত্র। বেবি ডকইয়ার্ডের কর্মী মো. নুরুজ্জামান বলেন, আমাদের ডকইয়ার্ডে শীতকালে ৫/৬টা জাহাজ একসঙ্গে মেরামত করা হয়। নদীতে অনেকগুলো জাহাজ অপেক্ষায় থাকত। বর্তমানে জাহাজ কম মেরামত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ডকইয়ার্ড অ্যান্ড শিপইয়ার্ড অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. মাসুদ হোসেন পলাশ বলেন, ডকইয়ার্ড স্থানান্তর এখন সময়ের দাবি। এখানে এই শিল্প গড়ে ওঠে ঢাকা নদীবন্দর তৈরির অনেক আগে থেকে। বর্তমানে জনসংখ্যা বেড়েছে, শহর বড় হয়েছে। এ শিল্পটা শহরের মাঝে পড়ে গেছে, যা আধুনিক শহরের সঙ্গে যায় না। আমার ডকইয়ার্ডে চার স্লিপার রয়েছে।
স্থানান্তর হলে এ চারটি স্লিপার পরিত্যক্ত হবে। এটা মেশিনারি না যে খুলে নিয়ে স্থানান্তর করব। নতুন করে এরকম স্লিপার চালু করতে আমাদের ১০/১২ কোটি টাকা লাগবে। আমার এখানে ১০ লাখ টাকাও নাই। এখানে ৫০/৬০ হাজার লোক এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে জাহাজ মালিকরাই কোনো রকমে টিকে আছেন। তারা এখন স্টাফের বেতন দিতে পারছেন না। তারা সচ্ছল থাকলে জাহাজ মেরামত করবেন।