বুধবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০১৩ ০০:০০ টা

অবসরে টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটা

অবসরে টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটা
২০১২ সালের শেষ মাসটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে ভারতের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিল্প গোষ্ঠী টাটা গ্রুপের জন্য। কারণ এ মাসেই অবসরে গেছেন টাটার ইতিহাসের সফলতম ব্যক্তি রতন টাটা। তিনি যখন তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানকে টাটা বলেছেন তখন প্রতিষ্ঠানটির আয় ১০ হাজার কোটি ডলার ছড়িয়ে গেছে। ৭৫ বছর বয়সী এই শিল্পপতি জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ সময় কাটিয়েছেন তিল তিল করে গড়ে তোলা এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এর মধ্যে ১৯৯১ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ২১ বছর ধরে এই গোষ্ঠীর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অবসরের পর প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে থাকবেন সম্মানসূচক ইমেরিটাস চেয়ারম্যান হিসেবে। প্রচণ্ড মেধাবী, সৎ ও নির্ভীক ব্যবসায়ী হিসেবে বিশ্বের মানুষের কাছে সুপরিচিত রতন টাটার নাম। অক্লান্ত পরিশ্রম, অসাধারণ মেধা, সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। সঠিক ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, লক্ষ্যে অটুট থাকা, আত্মবিশ্বাস ও ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা একজন মানুষকে কতটা সফল করে তুলতে পারে, তার বড় প্রমাণ রতন টাটা। ১৮৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত টাটা গ্রুপকে তিনি সময়োপযোগী আধুনিক একটি বৃহত্তর করপোরেট গ্রুপে পরিণত করেন। তার হাত ধরে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ও পরিচিত ব্র্যান্ডের তালিকায় নাম লিখিয়েছে টাটা গ্রুপ। ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানটির পণ্যকে তিনি নিয়ে গেছেন এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশে। রতন ভারতের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি চাচা জেহাঙ্গীর রতনজী দাদাভয় [জেআরডি] টাটার উত্তরসূরি নির্বাচিত হন ১৯৯১ সালে। এরপর টানা ২১ বছর টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজের ব্যবসায়িক মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে টাটার সম্পত্তির পরিমাণ বহু গুণে বাড়িয়ে তোলেন। ১৯৯১ সালে গ্রুপের আয়ের পরিমাণ ছিল বার্ষিক ১০ হাজার কোটি রুপি। রতনের হাতে ২০১১-১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় চার লাখ ৭৫ হাজার ৭২১ কোটি রুপিতে। এ ক্ষেত্রে তার বেশ কিছু সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও জায়গা করে নেয়। টাটার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি অর্জনের মধ্যে রয়েছে ২০০০ সালে ৪৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে টেটলি চা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, ২০০৭ সালে টাটা স্টিল ও ২০০৮ সালে টাটা মোটরসের ২৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগে জাগুয়ার ল্যান্ডরোভার গাড়ি নির্মাণ প্রকল্প। রতন টাটার হাত ধরে একে একে টাটা বেভারেজ, টাটা স্টিল, টাটা মোটরস, টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস, টাটা পাওয়ার, টাটা কেমিকেলস, ইন্ডিয়ান হোটেলস ও টাটা টেলিসার্ভিসেসসহ নতুন নতুন ব্যবসার সূচনা ঘটে। নতুন নতুন পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল দিয়ে প্রায় সব ক্ষেত্রেই অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেন রতন টাটা। কেবল দেশেই নয়, অল্প সময়ের মধ্যেই টাটার সাফল্য ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের অনেক দেশে। হিন্দুস্থান টাইমসের খবর অনুসারে, টাটা গ্রুপের ২৮টি শিল্পে প্রায় তিন লাখ মানুষ কাজ করে। রতন টাটা শুধু বাণিজ্য বিস্তারই করেননি, কর্মীসহ সাধারণ মানুষের কল্যাণে প্রতিষ্ঠানটির সূচনালগ্ন যে কল্যাণ ভাবনা ছিল, তারও বিস্তার ঘটিয়েছেন। চিকিৎসা, বিজ্ঞান, গবেষণা, খেলাধুলা, সংস্কৃতিসহ নানা খাতে আরও ভালো কিছুর জন্য অর্থ দিয়ে থাকে টাটা গ্রুপ। টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জমশেদ টাটার দুই ছেলে হলেন দোরাব ও রতন টাটা। রতনের বয়স যখন সাত বছর, তখন মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। দুই ভাই বড় হন নানী বেগম নাবাজবাইয়ের কাছে। বোম্বের ক্যাম্পিয়ন স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেন রতন। এরপর শিমলার বিশপ কটন স্কুলে পড়েছেন। শেষ করেছেন ক্যাথেড্রাল অ্যান্ড জন কোনান স্কুল থেকে। ১৯৬২ সালে তিনি কর্নওয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক পাস করেন। ১৯৭৫ সালে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে পড়াশোনা শেষ করেন। ১৯৬২ সালে টাটা গ্রুপে যোগ দেন। শুরুতে তিনি টাটা স্টিলের কারখানায় বেলচা দিয়ে চুনাপাথর সরানো ও চুলি্ল ঠিক রাখার কাজ করতেন। কিন্তু তখনো জীবনের অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি ছিল। ১৯৭১ তিনি ন্যাশনাল রেডিও অ্যান্ড ইলেকট্রনিঙ্ কোম্পানির নির্বাহী পরিচালকের পদে যোগ দেন। ১৯৮১ সালে টাটা ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান। এত বড় একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে কাজ করার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না রতন টাটার। তাই নিন্দুকেরা এ সময় তার সমালোচনা করতে থাকেন। তবে রতন টাটা অচিরেই তাদের মুখ বন্ধ করেন জাদুকরি সাফল্য দেখিয়ে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অকৃতদার। ১৯৯১ সালে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান রতন। তার সময়ই ভারতের কোম্পানি থেকে টাটা একটি বিশ্বজোড়া বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পায়। এখন টাটার মোট আয়ের ৬৫ শতাংশই আসে দেশের বাইরের বাণিজ্য থেকে। নেতৃত্বের গুণ যেন তার জন্মগত। যেখানেই হাত দিয়েছেন, পেয়েছেন সাফল্যের দেখা। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে ইতিহাসের পাতায় নাম খচিত রয়েছে রতন টাটার নাম। লবণ ব্যবসা থেকে শুরু করে সফটওয়্যার পর্যন্ত সব ব্যবসায়ই সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেছেন তিনি। তার অবদানের কারণেই ভারতের সর্ববৃহৎ গ্রুপে পরিণত হয় টাটা। ভারতের গোটা শেয়ারবাজারের ৭ শতাংশ টাটা শিল্পগোষ্ঠীর দখলে। ভারতের করপোরেট ট্যাঙ্রে ৩ শতাংশ এবং যাবতীয় আবগারি শুল্কের ৫ শতাংশ এই গোষ্ঠী জোগায়। আবাসন ব্যবসা থেকে শুরু করে এয়ারকন্ডিশনিং, হোটেল শিল্প, গাড়ি শিল্প, ফোন শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বীমা, ঘড়ি, পাদুকা এমনি অসংখ্য শিল্প ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। দীর্ঘ কর্মজীবনে রতনা টাটা লাভ করেছেন অসংখ্য স্বীকৃতি। ব্যবসায়িক সাফল্যের স্বীকৃতিও পেয়েছেন ঢের। বিশ্বের বিভিন্ন নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিক ডক্টরেট থেকে শুরু করে ২০০০ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ। ২০০৮ সালে পান পদ্ম বিভূষণ। রকফেলার ফাউন্ডেশনের আজীবন সম্মাননাও পান তিনি। অনেকের ধারণা, অবসর নিয়েও প্রকৃত অবসর নেবেন না তিনি। পর্দার আড়ালে থেকে কাজ করে যাবেন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে। ব্যবসার বৃত্তের মতো ব্যক্তিগত ভাবনা-চিন্তার পরিসরেও রতন টাটা একই রকম। সৎ, নিয়মনিষ্ঠ এবং সোজাসাপ্টা। যে কারণে ঘুষ দিয়ে বিমান পরিবহন ব্যবসায় নামার প্রস্তাবে মন্ত্রীর মুখের ওপর না বলে দিতে পারেন তিনি। কিংবা আলাপচারিতায় অক্লেশে বলতে পারেন নিজের জীবনে চার-চার বার প্রেম আসার কথা। রতন টাটা এ রকমই। এফ-সিঙ্টিনে চড়ার সময় যেমন, ব্যক্তিগত জীবনেও তা-ই। লক্ষ্যে স্থির, ঋজু। বরাবরের 'স্টেটসম্যান'। অযথা প্রচার থেকে একশো হাত দূরে। যার নমুনা অবসরের সময়ও রেখে যান তিনি। অনেকটা নিভৃতেই সাইরাসের হাতে সম্রাজ্য সঁপে দিয়ে বিদায় বলেছেন রতন।

সর্বশেষ খবর