শুক্রবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৩ ০০:০০ টা

মানুষের আগ্নেয় উত্থান

মইনুদ্দীন খালেদ

মানুষের আগ্নেয় উত্থান

বেগবান তেজস্বী মানুষ শাহাবুদ্দিনের শিল্পসৃষ্টির প্রেরণার উৎস বেগ ও তেজকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন মানুষের দেহে। তবে মানুষের দেহই তার গতি পর্যবেক্ষণের একমাত্র বিষয় নয়, অন্য প্রাণী অভিব্যক্তি একেও তিনি গতির অনুশীলন করেছেন। অপরাজেয় বেগে চালিত ঘোড়াদের দৌড়, ব্যাঘ্রমুখের ভয়ঙ্কর প্রকাশ এঁকেও রক্তের রাগের ক্ষুরধার পরিস্থিতি দর্শককে অবলোকন করাতে চেয়েছেন শিল্পী।

যুদ্ধে অবতীর্ণ মানুষ, প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ মানুষ, প্রতিবাদে প্রতিরোধে বুক চিতানো ঊধর্্ববাহু মানুষ; শাহাবুদ্দিনের ক্যানভাসে চিত্রিত হয়েছে মানুষের বিচিত্র উত্থান। আক্রমণের প্রাক্-মুহূর্তের হুঙ্কার এবং বিজয়ের উল্লাস, দুই একক যোদ্ধার বিস্ফারিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে কিংবা সমবেত যোদ্ধাদের বিজড়িত দেহ এঁকে তিনি শনাক্ত করতে চান। কেবলই ধাবমানতা, রক্তিম দেহের তাপ, তপ্ত দীর্ঘশ্বাস, সব মিলিয়ে গতির নতুন পুরাণ রচিত হয়েছে তার কাজে। শাহাবুদ্দিনের চৈতন্যে কখনো কোনো স্থবির জাতক জন্ম নেয় না। তার স্পেসে সমুত্থিত মানুষরা মহাকাব্যের বিপুল পরিধির কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই স্পেসে মূলত জয় ঘোষিত হয়েছে, রচিত হয়েছে ট্র্যাজিক উল্লাস। আহত-বিক্ষত মানুষের করুণ গোঙানিও রয়েছে। তবে মৃত্যু-পথযাত্রী বীরের মুখে বিপন্ন পরাস্ত হওয়ায় হতাশার ব্যঞ্জনা নেই। যাতনা আছে; ক্ষুব্ধতা আছে তার চেয়ে বেশি। কিন্তু নিথর লাশ এঁকে মৃত্যু উলি্লখিত হয়নি। কেননা শিল্পী আশাবাদী চেতনা লালন করেন এবং তিনি একদা যে প্রতিজ্ঞা নিয়ে স্বদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন সেই অঙ্গীকারের অঙ্গার এখনো ধিকিধিকি জ্বলছে তার অন্তরে। তিনি এখনো কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারেননি। তাই তার যুদ্ধ সচল রয়েছে। ছবি আঁকাটা শাহাবুদ্দিনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে সজীব সবলভাবে বেঁচে থাকার বিষয়। তবে শুধু যুদ্ধ বা যোদ্ধা নয়, যেখানেই তিনি মানুষি শক্তির জাগরণ দেখেন, ছন্দময় প্রকাশ পর্যবেক্ষণ করেন, শক্তির পরাকাষ্ঠা প্রত্যক্ষ করেন তাকেই শৈল্পিক ভাষ্য দিতে চান। তবে বেদনায় বিদীর্ণ অবয়বেও প্রকাশের খরবেগ দেখতে পেয়েছেন তিনি। এই উপমহাদেশের তত্ত্বগত শাস্ত্রের বিচারে শিল্পী মূলত রুদ্র ও বীর রসের সংক্রমণ ঘটিয়েছেন তার কাজে। সৃজনশীল মানুষের এই উদ্দামতা আমরা অনুভব করেছি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়। 'আমি উল্লাস; আমি অগ্নি; আমি জ্বালা'; এসব উচ্চারণে বিদ্রোহী কবি যেভাবে আগ্নেয় উদ্গিরনের মতো নিজের ভেতরের 'আমি'কে প্রকাশ করেছেন শিল্পী শাহাবুদ্দিনের ছবিও তার শিল্পী চৈতন্যের সংখ্য অগ্নি ময় 'আমি'র প্রকাশ।

শাহাবুদ্দিন বীর পূজারি। বীরের মধ্যে যে অপরিমেয় শক্তি রয়েছে তা কী করে প্রমাণ করা যায় তার পরীক্ষায় তিনি লিপ্ত হয়েছেন। তিনি বারবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আঁকছেন। এবং তিনি আরও অনেক দেশপ্রেমিকের মতো নির্দ্বিধায় স্বীকার করেন শেখ মুজিবুর রহমান জাতির জনক। জনসভায় দাঁড়ানো উত্তোলিত বাহুর মহানায়ককে তিনি বহুবার চিত্রিত করেছেন। গুলিবিদ্ধ মহানায়ক, বেদনামথিত ও যন্ত্রণায় কাতর বঙ্গবন্ধুও তার ছবির বিষয় হয়েছেন। বিচিত্র অভিব্যক্তিতে ইতিহাসের মহানায়ককে এঁকে তিনি তার সন্দর্ভ রচনা করে চলেছেন। শাহাবুদ্দিন গান্ধীকে এঁকেছেন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে চিত্রিত করেছেন। শান্তিকামী গান্ধীর চোখ শিল্পী এমনভাবে এঁকেছেন যে, তা দেখলেই বোঝা যায় চমশার ফ্রেম ভেদ করে তা কীভাবে তির্যকভাবে দৃষ্টিপাত করেছে। নজরুলের চোখের শক্তিও শিল্পী পরিমাপ করেছেন। ব্যক্তির শক্তিকে ছবির মধ্য দিয়ে পুনরাবিষ্কার করার এই যে প্রয়াস তা এ দেশের শিল্পচর্চার ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। আমরা অনেক প্রতিকৃতি রচিত হতে দেখেছি, কিন্তু এরকম প্রকাশজর্জর মানব-অবয়ব দেখিনি। অবয়বের সাধভরণ চেনা রূপ বিচূর্ণ করে তাকে শক্তি ও তেজের উৎসে পরিণত করার মধ্যে শাহাবুদ্দিনের বিশেষ শৈল্পিক পারমিতা রয়েছে। শিল্পে শিল্পীর সৃজন প্রক্রিয়া মুদ্রিত হয়। শিল্পী আসলে নিজেকেই আঁকেন অন্যকে নয়। এসব স্বতঃসিদ্ধ উপলব্ধির এক উদার জমিন শাহাবুদ্দিনের ক্যানভাস। শাহাবুদ্দিন নিরীক্ষাধর্মী ফিগারিটিভ আর্টিস্ট। তবে যতটুকু মানবদেহ তার কাজে প্রকাশিত তার চেয়ে বেশি সেই দেহবর্ণে অবলুপ্ত। শাহাবুদ্দিন যতখানি অবয়বনির্ভর, তার চেয়ে বেশি নিরাবয়ব; বিমূর্ত-বর্ণে প্রকাশিত। তার মানুষি দেহে ত্বক নেই; আছে পেশি ও রক্তের নাচন। নিজেকে প্রকাশের চালটা কতটা স্বয়ংক্রিয়তায় ন্যস্ত রাখা যায় এটাই এ শিল্পীর এক প্রধান মনোভঙ্গি।

ওই মনোভঙ্গি ধরে শাহাবুদ্দিনকে বুঝতে হলে তার ছবি জন্ম নেওয়ার ইতিবৃত্তটা জানা সমীচীন। তার ছবি যে অঙ্গ-প্রতঙ্গের বিচিত্র প্রকাশ তা তো তারই দেহজাত। নিজের দেহের গতিই চিত্রে প্রোথিত করেন শিল্পী। নিজে গেরিলা-যোদ্ধা হিসেবে জীবন বাজি রেখে যে লড়েছিলেন তা এক অবিনাশী সঞ্চয়। এখন শিল্পী টিভি পর্দায় ও খেলার পত্রিকায় নানা ক্রীড়ার প্রতিযোগীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন। নিজেও ক্রিকেট, টেবিল-টেনিস খেলেন। যদিও টেবিল-টেনিস তাকে আনন্দ দেয়, তবু তা আনন্দ অনুভবেই সীমাবদ্ধ নয়। নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি, আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণের মধ্য দিয়ে দেহ যে বিচিত্র দিকে ধাবিত হয় তা বোধহয় শাহাবুদ্দিনকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের শিল্প রচনায় বিশেষ সুবিধা জুগিয়েছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মতোই শাহাবুদ্দিন বর্ণমাখা তুলি নিয়ে ক্যানভাসে রূপ দেন। কব্জিকে ঘুরিয়ে বর্ণের ঘূর্ণি তৈরি করেন। তার অনেক চিত্রগত পরিমার্জনা মণিবন্ধের নানামুখী ঘূর্ণন থেকে সৃষ্টি।

শাহাবুদ্দিনের ছবির মানুষ আর মানুষ থাকে না, তা হয়ে যায় শুভ্র আকাশে ধূমকেতু। জাগরণ আর উত্থানের মহাকাব্য রচনা করেছেন শিল্পী। উৎসবের হর্ষোৎফুল্ল মানুষ, সংগ্রামে যুদ্ধংদেহী মানুষের সমবেত যাত্রা_ দুই-ই আশাবাদী শিল্পীকে প্রাণিত করে রাখে। তবে একক মানুষের বিচিত্র প্রকাশই শাহাবুদ্দিনের শিল্পে বিশেষ অভিনিবেশ দেখার সময়। মানুষ তির্যকভাবে তীরের মতো বেগবান, অগি্নপিণ্ডের মতো শূন্য থেকে ছুটে আসছে কিংবা শূন্যে হারিয়ে যাচ্ছে। পুঞ্জীভূত শক্তিকে পুঞ্জীভূত বর্ণ দিয়েই শনাক্ত করতে চান শিল্পী। বর্ণই শক্তি, এখন বর্ণই ঈশ্বর হয়ে উঠেছে তার কাজে।

একদিকে শক্তি পুঞ্জীভূত হয়ে অগি্নপিণ্ডের রূপ নিচ্ছে, অন্যদিকে শক্তির চাড়ে প্রসারিত হচ্ছে সংগ্রামশীল মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গ। কোনোভাবেই পরিচিত চেনা অবয়ব আর প্রামাণিকতায় থাকছে না। প্রমাণ-আয়তনকে ভেঙে প্রলম্বিত ও প্রসারিত যে ইমেজ বা ইমেজরাশির জন্ম দেন শাহাবুদ্দিন তা-ই সৃজন-চেতনা, মানসিক অবস্থা, মনের সেই মুহূর্তের পরিস্থিতি। এই অন্তর্ভেদী বিশ্লেষণের পর আমরা বুঝতে পারি শাহাবুদ্দিনের ছবিতে দেহজ অনুষঙ্গ এক উপলক্ষ মাত্র, তিনি গতিকে মনোবেগকে, সৃজনচেতনাকেই চিত্রার্পিত করে চলেছেন। পেইন্টারলি ইফেক্ট বা বর্ণ-প্রতিক্রিয়া অথবা বর্ণ-পরিমার্জনার এক বিরল শৈল্পিক স্বাক্ষরও এই গতির শিল্পী। নতুন গতিতত্ত্ব যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে শাহাবুদ্দিনের ছবিতে।

যে নাটকীয় দোলা বা মহাকাব্যিক কাহিনীর ঝড় উঠে শিল্পীর স্পেসে তা পশ্চিমের শিল্পচর্চার পরম্পরার মধ্য দিয়ে যদি বিবেচনা করি তবে রুবেন্সের পৌরাণিক চিত্র, দোলাক্রোয়ার রোমান্টিসিজম, গ্যয়ার আতঙ্ক-জর্জর মানুষের মুখ মনে পড়বে। আর সে বর্ণশুদ্ধির কাছে শাহাবুদ্দিন চলে এসেছেন তাতে ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীগুরু মনকে মনে করিয়ে দিতে পারে। একদিকে গতি ও অন্যদিকে বর্ণের অতিশোধন এই প্রক্রিয়ার সমন্বয় করতে চান শিল্পী। তবে অবয়বকে বিচূর্ণকরণ বা ডিসটরটশন আনার ক্ষেত্রে ফ্রান্সিস বেকন শাহাবুদ্দিনকে পথ দেখিয়েছেন। বেকন শাহাবুদ্দিনের প্রিয় শিল্পী। এক সময় ফরাসিরা তাকে 'পতি বাঁকো' বা পাতি বেকন বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। শাহাবুদ্দিন বেকন অনুসারী হয়েছিলেন বিশেষ বর্ণলেপনে অবয়ব চূর্ণ-বিচূর্ণ করে। বেকনে ভাঙন এসেছে অস্তিত্ববাদ ও নৈঃসঙ্গবোধ থেকে, অপরপক্ষে শাহাবুদ্দিন ফিগার ভেঙেছেন স্বপ্ন ও আশার উজ্জীবনে। তার স্পেসে আজ আশা, আনন্দ, আতঙ্ক, ক্ষোভ বর্ণের দীর্ঘ দৃষ্টিনন্দন প্রলেপ অনুভূত হয়। আর বোধগুলো খলবলিয়ে প্রকাশ করেন শিল্পী ড্রিপিং বা রং গড়িয়ে ছিটিয়ে আরোপ করে। মূল ইমেজের অদূরে শূন্য স্পেসে হালকা রেখার সংকেতে গতির চৌম্বকীয় আবেশ তৈরি করেন শিল্পী। কখনো এক প্রস্থ বর্ণই শুধু কামারের হাঁপড় থেকে অগি্নকণা ছিটকে আসার মতো উড়ে এসে সাদা স্পেসে লেগে থাকে। এসব পরিমার্জনায় মানব-অস্তিত্ব অর্থাৎ গতির জঙ্গম স্বরূপ অনূদিত হয়ে পড়ে শাহাবুদ্দিনের শিল্পে।

 

 

সর্বশেষ খবর